স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ, পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থার উদ্বৃত্ত অর্থ সরকারের কোষাগারে জমা নিতে আইন করেছে সরকার। সরকারের এ আইন পরিপালন করতে গিয়ে বিপদে পড়েছে অনেক প্রতিষ্ঠান। দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে জমা রাখা আমানত এখন আর ফেরত পাচ্ছে না সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সরকারি প্রতিষ্ঠানের আমানত ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়া এসব ব্যাংকের অন্যতম পদ্মা ব্যাংক লিমিটেড। ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ বলছে, এ মুহূর্তে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানতের অর্থ চলে গেলে পদ্মা ব্যাংককে টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়বে।

বিপর্যস্ত ও বিধ্বস্ত অবস্থা থেকে পুনরুদ্ধারে সাবেক ফারমার্স ব্যাংককে পুনর্গঠন করা হয়েছিল পদ্মা ব্যাংক হিসেবে। পরিসংখ্যান বলছে, ব্যাংকটিতে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আমানত রয়েছে ১ হাজার ৭৩৯ কোটি ৪০ লাখ টাকা। এসব আমানতের মেয়াদ পূর্ণ হয়েছে কয়েক বছর আগেই। বারবার তাগাদা সত্ত্বেও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর আমানত ফেরত দিতে পারছে না পদ্মা ব্যাংক। খোদ ব্যাংক কর্তৃপক্ষই বলছে, এসব আমানত ফেরত দিলে পদ্মা ব্যাংকের জন্য নিজেকে টিকিয়ে রাখাই দুষ্কর হয়ে পড়বে। সে সক্ষমতা ব্যাংকটির এখনো হয়নি। এজন্য ২০২৩ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদে অর্থাৎ আরো আট বছর সময় নিয়ে এসব আমানত পরিশোধ করতে চায় ব্যাংকটি। বিষয়টি নিয়ে অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের কাছে চিঠি দিয়েছে ব্যাংক কর্তৃপক্ষ। পদ্মা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এহসান খসরুর লেখা ওই চিঠিতে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আমানত ধরে রাখার বিষয়ে অর্থমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করা হয়েছে।

মেয়াদি আমানত হিসেবে পদ্মা ব্যাংকে ১০৭ কোটি টাকা রেখেছিল সরকারি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ ইনফ্রাস্ট্রাকচার ফাইন্যান্স ফান্ড লিমিটেড (বিআইএফএফএল)। পদ্মা ব্যাংকে আটকে থাকা আমানত উদ্ধারে বাংলাদেশ ব্যাংকের হস্তক্ষেপ চেয়েছিল বিআইএফএফএল। এরই ভিত্তিতে পদ্মা ব্যাংককে চিঠি দিয়ে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে বিআইএফএফএলের ১০৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা ও পাওনা সুদ পরিশোধের জন্য সময়সীমা বেঁধে দেয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এর ভিত্তিতে বিআইএফএফএলসহ সরকারি অন্য প্রতিষ্ঠানের আমানত পরিশোধে অপারগতা প্রকাশ করে পদ্মা ব্যাংক থেকে ওই চিঠি দেয়া হয়।

প্রসঙ্গত, বিআইএফএফএল নিজেও খুব একটা সুবিধাজনক পরিস্থিতিতে নেই। অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগের জন্য এক দশক আগে বিশেষায়িত এ আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা হয়েছিল। যদিও লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হয়ে প্রতিষ্ঠানটি ৫৮৪ কোটি টাকা এমন সব দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে ঋণ দিয়েছে, যেগুলো আদায়ের সম্ভাবনা ফিকে হয়ে আসছে।

প্রতিষ্ঠানটির সাবেক ফারমার্স ব্যাংকসহ বিভিন্ন দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ৫৮৪ কোটি টাকা বিনিয়োগে অনিয়ম-দুর্নীতির অভিযোগ তুলেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এ বিপুল পরিমাণ টাকা অনাদায়ের ঝুঁকিতে ফেলার অভিযোগে গত বছরের অক্টোবরে সরকারি বিশেষায়িত আর্থিক প্রতিষ্ঠানটির সাবেক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম ফরমানুল ইসলামসহ দুজনের বিরুদ্ধে মামলাও করা হয়।

পদ্মা ব্যাংকের কাছ থেকে টাকা আদায়ের বিষয়ে বিআইএফএফএলের বর্তমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এসএম আনিছুজ্জামান বণিক বার্তাকে বলেন, মূল টাকা পরিশোধ না করলেও পদ্মা ব্যাংক আমাদের বিনিয়োগের বিপরীতে সুদ পরিশোধ করেছে। ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমাদের নিয়মিত যোগাযোগ হচ্ছে। বিআইএফএফএল প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল অবকাঠামো নির্মাণ খাতে বিনিয়োগের জন্য। পদ্মা ব্যাংকসহ অন্য ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অর্থ ফেরত পেলে আমরা অবকাঠামো খাতে বিনিয়োগে জোর দিতাম।

অর্থমন্ত্রীকে লেখা পদ্মা ব্যাংক এমডির চিঠির ভাষ্য অনুযায়ী ব্যাংকটি গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে নিজস্ব আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় রেখে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত আমানতকারীদের সুদ দিচ্ছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে আসলসহ সুদ পরিশোধ করা হচ্ছে। কিন্তু সাম্প্রতিককালে সময়সীমা বেঁধে দিয়ে বিআইএফএফএলের ১০৭ কোটি ৫৪ লাখ টাকা এবং এর ওপর সুদসহ পাওনা পরিশোধ করার জন্য বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এরই মধ্যে আমরা কয়েক লাখ আমানতকারীর আমানত তাদের আস্থা অর্জনের মাধ্যমে সংরক্ষণ ও পুনর্নবায়ন করতে সক্ষম হয়েছি। একই সঙ্গে নতুন নতুন আমানত সংগ্রহের মাধ্যমে পদ্মা ব্যাংক তার প্রবৃদ্ধি অর্জন করে চলেছে। কিন্তু এ মুহূর্তে ব্যাংকটির আর্থিক সক্ষমতার বিষয়টি বিবেচনায় না রেখে এ ধরনের বড় বড় পাওনা পরিশোধ করলে ব্যাংকটিকে টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে পড়বে।

এহসান খসরু চিঠিতে উল্লেখ করেন, গ্রাহকদের পাওনা পরিশোধে পদ্মা ব্যাংক প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। ব্যাংক কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করে, সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার আমানত ২০২৩ সাল থেকে পাঁচ বছর মেয়াদি পরিশোধ পরিকল্পনার মাধ্যমে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হবে। এছাড়া এরই মধ্যে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম চালু করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, অচিরেই তা বাস্তবায়ন করা হবে।

চিঠির বিষয়ে এহসান খসরু বণিক বার্তাকে বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের উদ্বৃত্ত টাকা যেমন সরকারি কোষাগারে রাখার আইন করা হয়েছে, তেমনি এসব প্রতিষ্ঠানের অর্থের অর্ধেক সরকারি ব্যাংকে এবং অর্ধেক বেসরকারি ব্যাংকে রাখার বিধানও বহাল আছে। তাই আমরা যে সময়টা চেয়েছি, সেটা বাস্তবায়নে আইনের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। তবে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে এখনো দিকনির্দেশনা পাইনি। এরই মধ্যে বিআইএফএফএলসহ অনেক প্রতিষ্ঠানের আমানতের অর্থ ফেরত দেয়া শুরু করেছি।

অর্থমন্ত্রীকে দেয়া চিঠিতে এহসান খসরু উল্লেখ করেন, ২০১৯ সালে ২৯৮ কোটি টাকা লোকসান দিয়ে পদ্মা ব্যাংক কার্যক্রম শুরু করেছিল। তবে ২০২০ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকটির লোকসানের পরিমাণ কমে দাঁড়িয়েছে ১৫৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ দুই বছরে ব্যাংকটির মোট লোকসানের পরিমাণ হচ্ছে ৪৫৫ কোটি টাকা। ২০২০ সাল শেষে পদ্মা ব্যাংকের এডি রেশিও ৯৩ শতাংশে নেমেছে, ২০১৮ সালে যা ছিল ১১৮ শতাংশ। ২০১৯ সালে ব্যাংকটির বিতরণকৃত মোট ঋণের ৭৮ দশমিক ১০ শতাংশ খেলাপি ঋণে পরিণত হয়েছিল। তবে ২০২০ সালে তা কমে দাঁড়িয়েছে ৬১ দশমিক ৪৫ শতাংশে।

২০১৯-২০ অর্থবছর থেকে সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার উদ্বৃত্ত টাকা রাষ্ট্রীয় ব্যয় নির্বাহের জন্য সরকারি কোষাগারে জমা নিচ্ছে সরকার। অর্থ বিভাগ জানিয়েছে, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো এখন পর্যন্ত এ বাবদ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে মোট ২৩ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা জমা দিয়েছে। সরকারি হিসাব বলছে, ২০১৯-২০ অর্থবছরে স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত, সংবিধিবদ্ধ সরকারি কর্তৃপক্ষ ও পাবলিক নন-ফাইন্যান্সিয়াল করপোরেশনসহ দেশের মোট ৬৮টি স্বশাসিত সংস্থার মোট ২ লাখ ১২ হাজার ১০০ কোটি টাকা অলস হিসেবে বিভিন্ন ব্যাংকে জমা পড়ে ছিল। সে সময় এ অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে নিতে আইন প্রণয়ন করে সরকার।

অর্থ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আইনটি প্রণয়নের পর গত অর্থবছরে (২০১৯-২০) আটটি সংস্থা থেকে মোট ১৬ হাজার ৪৬ কোটি টাকা পেয়েছিল সরকার। চলতি অর্থবছরেও সরকারের এ বাবদ কমপক্ষে ১৫ হাজার ৮০০ কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা গ্রহণের লক্ষ্য রয়েছে। এর মধ্যে এ পর্যন্ত সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা জমা পড়েছে। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত স্বশাসিত সংস্থাগুলো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দিয়েছে উদ্বৃত্ত অর্থের ২৩ হাজার ৫৪৬ কোটি টাকা।

অর্থ মন্ত্রণালয়ের অর্থ বিভাগসংশ্লিষ্টরা বলছেন, সরকারি অনেক সংস্থা নিজেদের উদ্বৃত্ত অর্থ ব্যাংকে রেখে মুনাফা করত। কোনো কোনো সংস্থা এ অর্থ থেকে কর্মকর্তাদের অতিরিক্ত বোনাসও দিয়েছে। পরিস্থিতি বিচারে আইনটি সময়োপযোগী ছিল। স্বশাসিত সংস্থাগুলোর তহবিল থেকে আসা সাড়ে ২৩ হাজার কোটি টাকা কভিড-১৯ সংক্রমণের দুঃসময়ে বেশ কাজে লেগেছে। দুর্বল ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সরকারি সংস্থার রাখা আমানত উদ্ধারে সরকার কঠোর হবে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে কার্যক্রম শুরু করা ফারমার্স ব্যাংক অনিয়ম-দুর্নীতির ভারে মারাত্মক বিপর্যয়ের মুখে পড়ে। যাত্রার মাত্র পাঁচ বছরের মধ্যেই প্রায় ধসে পড়েছিল ব্যাংকটি। ধারাবাহিকভাবে গ্রাহকদের আমানতের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হওয়ায় ২০১৭ সালে ফারমার্স ব্যাংকে হস্তক্ষেপ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। পুনর্গঠন করা হয় ব্যাংকটির পরিচালনা পর্ষদ। অপসারণ করা হয় ব্যবস্থাপনা পরিচালককে। বিপর্যস্ত ব্যাংকটিকে টেনে তুলতে এগিয়ে আসে অর্থ মন্ত্রণালয়। এক্ষেত্রে সহযোগীর ভূমিকা পালন করে বাংলাদেশ ব্যাংক। সরকারের সিদ্ধান্তে ফারমার্স ব্যাংকের ৬৮ শতাংশ মালিকানা কিনে নেয় রাষ্ট্রায়ত্ত প্রধান চার ব্যাংক ও ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশ (আইসিবি)। এজন্য ঢালতে হয়েছে ৭১৫ কোটি টাকার পুঁজি। ফারমার্স ব্যাংক থেকে নাম পরিবর্তন করে ব্যাংকটির নতুন নাম দেয়া হয় পদ্মা ব্যাংক।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *