দেশে করোনা সংক্রমণ ও মৃতু্যর হার ভয়াবহভাবে বাড়লেও জীবন নিয়ে যত মানুষ উদ্বিগ্ন, এর চেয়ে অনেক বেশি মানুষ জীবিকা নিয়ে উৎকণ্ঠিত। বিশেষ করে নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রেণির পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ, যাদের আয়-উপার্জন দৈনন্দিন কর্মের ওপর নির্ভরশীল- তারা জীবিকা নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় পড়েছেন। এই শ্রেণি-পেশার কোটি কোটি মানুষ মৃতু্যভয় উপেক্ষা করে জীবনের ঝুঁকি নিয়েই নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে তৎপর থাকতে চাইছেন।

গত কয়েকদিন ধরে তারা নানাভাবে তাদের এই অবস্থান জানান দিলেও ৫ এপ্রিল থেকে সপ্তাহব্যাপী লকডাউনে সরকারের আনুষ্ঠানিক ঘোষণার পর তাদের একটি অংশ রাস্তায় নেএেসেছেন। রোববার দুপুরের পর রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মার্কেট কর্মচারীরা সড়ক অবরোধ করে তাদের কর্মক্ষেত্র সচল রাখতে জোর দাবি জানিয়েছেন। এর আগে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসের মাধ্যেেমাটরসাইকেলে যাত্রী তোলার ওপর নিষেধাজ্ঞা দেওয়ায় ১ এপ্রিল বিক্ষোভ করেন চালকরা। জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কয়েকশ’ মোটরসাইকেলচালক তাদের যান রাস্তায় রেখে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন এবং এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাহারের দাবি জানান। পরে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় এই বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। শাহবাগ এলাকা অবরোধ করেন রাইড শেয়ারিংয়ের চালকরা।

এদিকে মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে রোববার দুপুরের পর ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট, নূর ম্যানসন, ধানমন্ডি হকার্স ও বসুন্ধরাসহ বিভিন্ন মার্কেটের সামনে রাস্তা অবরোধ করে ব্যবসায়ীদের ব্যানারে বিক্ষোভ করা হলেও এতে মূলত অংশ নেন দোকান কর্মচারীরা। তারা জানান, তাদের সারাবছরের বেচাকেনা হয় মূলত রমজান মাসে। তাই সময় মার্কেট বন্ধ থাকলে ব্যবসায়ীদের ‘সর্বনাশ’ হবে। যার মূল ধাক্কা দোকান কর্মচারীদের ওপর পড়বে। তাই তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে রাস্তায় নেমেছেন।

আন্দোলনরত শ্রমিকরা লকডাউন আরও দীর্ঘমেয়াদি হতে পারে- এমন আশঙ্কার কথা জানিয়ে বলেন, গত বছর সরকার ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেছিল। সব প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু এই সাধারণ ছুটির মেয়াদ পরবর্তীতে এতটা দীর্ঘ হবে, তা সে সময় কেউই ভাবতে পারেননি। ওই সময় সরকারি-বেসরকারি চাকরিজীবীরা কমবেশি বেতন পেলেও দোকান কর্মচারীদের ধার-কর্জ করে চলতে হয়েছে। অনেককে সহায়-সম্বলহীন অবস্থায় গ্রািেফরতে হয়েছে। তাই তাদের কাছে জীবনের চেয়ে এখন জীবিকার ব্যবস্থা সচল রাখাই বড় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাদের যুক্তি, করোনাভাইরাসে ২০-২২ শতাংশ মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে। যা বেড়ে ৩০ শতাংশে দাঁড়াতে পারে। এতে তাদের মত নিম্ন-মধ্যবিত্ত মানুষের হার ১০ থেকে

বড়জোর ১৫ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এর ১ থেকে দেড় শতাংশ মানুষ মারা যেতে পারে। অথচ তাদের জীবিকার পথ বন্ধ হয়ে গেলে এই শ্রেণির অনেক বেশি মানুষকে জীবিত থেকেও ‘মৃতু্যমুখে’ পড়তে হবে।

শ্রমজীবী অনেকেই ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, বাংলাদেশে যেকোনো সংকট তৈরি হলেই সবার আগে গার্মেন্ট শ্রমিকদের কথা ওঠে। তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে আলোচনা হলেও পরিবহণ শ্রমিক, রিকশাচালক, দোকান কর্মচারীসহ অন্য শ্রমিকরা এর বাইরেই থেকে যায়। লকডাউনে কর্মহীন হয়ে পড়লে তাদের কোথায় হাত পাততে হবে, তা নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় না।

এদিকে বিভিন্ন পেশার মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ অভিযোগ তুলে বলেন, গত বছর লকডাউন শুরুর পর থেকে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ত্রাণ কার্যক্রপরিচালিত হয়েছে। যা অনেকটা সিন্ধুতে বিন্দুর মতো। তবে ক্ষেত্রেও হতদরিদ্র মানুষ প্রাধান্য পেয়েছে। কিন্তু মধ্যবিত্তের কী অবস্থা; তার দিকে কেউই নজর দেয়নি। ওই সময় বহু প্রতিষ্ঠান তাদের কর্মীদের বেতন বন্ধ করে দিয়েছে, অনেককে ছাঁটাই করা হয়েছে। তাই এবার লকডাউনের ঘোষণা আসার পর তারা করোনায় মৃতু্যঝুঁকির চেয়ে জীবিকা নিয়ে বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে উঠেছেন।

অনেকে আবার নিয়ে ভিন্ন যুক্তিও দেখিয়েছেন। তাদের ভাষ্য, বেশ কয়েকদিন ধরেই রাজধানীর কোনো হাসপাতালে কোভিড-১৯ চিকিৎসার সিট খালি নেই বলে জানানো হচ্ছে। ৪-৫ জন করোনা রোগী অ্যাম্বুলেন্সে চড়ে এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতাল ঘুরে আইসিইউ না পেয়ে মারা যাওয়ার খবরও প্রকাশিত হয়েছে। অবস্থায় তাদের মতো যাদের জীবিকা বন্ধ হবে, তারা খাদ্য ও চিকিৎসা সংকটে পড়বে।

নিম্ন-মধ্যবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের এই দৃষ্টিভঙ্গি সম্পর্কে সমাজবিজ্ঞানীরা বলেন, সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করা না গেলে অবস্থার পরিবর্তন করা একেবারেই অসম্ভব। তারা গত বছরের এপ্রিলে আকস্মিক গার্মেন্ট খুলে দেওয়ার ঘোষণার পর ঢাকা-টাঙ্গাইল এবং ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে ঢাকামুখী গার্মেন্ট শ্রমিকদের ঢল নামার বিষয়টি স্মরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, তারা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে, তাদের কাছে জীবনের চেয়ে জীবিকা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। তাই এবারও একই মনোভাব দেখা দেবে- এটাই স্বাভাবিক বলে মনে করেন তারা।

মার্কেট ব্যবসায়ীদের বিক্ষোভ : লকডাউন চলাকালে স্বাস্থ্যবিধি মেনে মার্কেট খোলা রাখার দাবিতে রাজধানীর নিউমার্কেটে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন ব্যবসায়ীরা। এতে মিরপুর রোডে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। সময় পুলিশের পক্ষ থেকে অবরোধ তুলে নেয়ার অনুরোধ জানালে বিক্ষুদ্ধ ব্যবসায়ীরা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করেন।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, রোববার বিকাল ৩টায় চন্দ্রিমা সুপার মার্কেট, ঢাকা নিউ সুপার মার্কেট, নূর ম্যানশন, ধানমন্ডি হকার্স মার্কেটসহ আশপাশের মার্কেটের ব্যবসায়ীরা সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ শুরু করেন। সময় ব্যবসায়ীরা ‘লকডাউন মানি না, মার্কেট খোলা চাই’ স্স্নোগান দেন। সময় তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল ছুড়লে পুলিশ পিছু হটে ঢাকা কলেজের সামনে অবস্থান নেয়। বিক্ষুব্ধ ব্যবসায়ীরা পাঁচটি প্রাইভেটকার ও একটি বাসের কাঁচ ভাঙচুর করেন।

নিউমার্কেট ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি দেওয়ান আমিনুল ইসলাসিরাজ বলেন, করোনা সংক্রমণ প্রতিরোধে লকডাউন দিলে শতভাগ লকডাউন দিতে হবে। কোনো কোনো খাত ছাড় দিয়ে কোনো কোনোটির ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করাটা অন্যায়। ব্যবসায়ীরা দোকানপাট খোলা রাখতে পারলে নিজেদের খাবার-দাবারের সংস্থান হবে, কর্মচারীরা বেতন পাবেন। সারাবছর ব্যবসায়ীরা এই সময়ের দিকে তাকিয়ে থাকেন। ঈদের সময় ক্ষয়ক্ষতি পুষিয়ে নেন। তিন ধাপে ব্যবসা ভেদে সময় কেনাবেচা হয়। রোজার আগের ১৫ দিন, রোজার প্রথ১৫ দিন এবং শেষ ১৫ দিন। সময় এসে দোকানপাট বন্ধ হওয়া মানে পথে বসে যাওয়া।

বিকাল ৪টার দিকে একই দাবিতে বসুন্ধরা শপিং মলের ব্যবসায়ী ও কর্মচারীরা মলের সামনের সড়কে বিক্ষোভ-মিছিল করেন।

রাইড শেয়ার চালকদের মানববন্ধন : রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেলসেবা চালু বা বিকল্প কর্মসংস্থান করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন চালকরা। রোববার সকালে রাজধানীর জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এক মানববন্ধন কর্মসূচিতে এই দাবি জানান রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে যুক্ত মোটরসাইকেলচালকরা।

করোনার সংক্রমণ বেড়ে যাওয়ার প্রেক্ষাপটে রাইড শেয়ারিং সার্ভিসে মোটরসাইকেলে যাত্রী পরিবহণে সরকারের দেওয়া নিষেধাজ্ঞার প্রতিবাদে এই মানববন্ধন করা হয়। ঢাকা রাইড শেয়ারিং ড্রাইভারস ইউনিয়ন এই মানববন্ধনের আয়োজন করে। কর্মসূচিতে কয়েকশ মোটরসাইকেলচালক অংশ নেন। তারা রাইড শেয়ারিংয়ে মোটরসাইকেলসেবা পুনর্বহালের দাবি জানান।

মানববন্ধনে মোটরসাইকেলচালকরা বলেন, রাজধানীতে প্রায় দুই লাখ মোটরসাইকেলচালক আছেন। রাইড শেয়ারিংয়ের মাধ্যতোদের সংসার চলে। এই সেবার ওপর নির্ভর করে অন্তত ৩০ লাখ মানুষের খাবার আসে। সরকার এসবের কোনো কিছু না ভেবে সরাসরি সেবাটি বন্ধ করে দিয়েছে। বিকল্প কর্মসংস্থানেরও কোনো ব্যবস্থা করা হয়নি।

কর্মসূচিতে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক বেলাল আহমেদ বলেন, ‘সরকার আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করে দিক অথবা আমাদের বাইক চালানোর সুযোগ দেওয়া হোক, আমরা নিজেরাই আমাদের খাবার খুঁজে নেব। আর যদি সেবা বন্ধ রাখতে হয়, তাহলে সরকারের কাছে আমাদের আহ্বান, যেন বিকল্প কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়।’

মানববন্ধনে সংগঠনের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বলেন, করোনার সংক্রমণ রোধের অজুহাতে সরকার রাইড শেয়ারিংসেবা বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এর ফল কী হচ্ছে? সাধারণ মানুষ গণপরিবহণে গাদাগাদি করে চলাচল করছে। অন্যদিকে, মোটরসাইকেলচালকদের পরিবার নিয়ে অসহায়ভাবে দিন কাটাতে হচ্ছে। সোমবার থেকে শুরু হতে যাওয়া লকডাউনে এই পরিবারগুলোকে না খেয়ে দিন কাটাতে হবে। – যায়যায়দিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *