ঢাকার দুই সিটির পরিবহন শাখায় অনিয়ম বিশৃঙ্খলা লুটপাট
ক্লিনার সুইপার মালী মশককর্মী ও বহিরাগতরা চালায় বর্জ্যবাহী ট্রাক কম্প্যাক্টর

ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) নিজস্ব যানবাহন আছে ৬০৯টি। চালক আছে মাত্র ১৭৩ জন। তাহলে বাকি গাড়িগুলো চালায় কারা? বহিরাগত, মশককর্মী, মালী, ক্লিনার, সুইপার, এমএলএসএস পদধারী বা বহিরাগত চালকরাই এসব গাড়ির চালক। এদের না আছে ভারী যান চালানোর লাইসেন্স, না আছে হালকা যান চালানোর লাইসেন্স, না আছে কোনো প্রশিক্ষণ। নামকাওয়াস্তে স্টিয়ারিং ধরা শিখেই তারা ডাম্প ট্রাক, কম্প্যাক্টর বা পে-লোডারের মতো ভারী যানবাহনের চালক বনে গেছে। তাদের দিয়েই দিনের পর দিন, বছরের পর বছর চালানো হচ্ছে অসংখ্য ভারী যানবাহন।
গত বুধবার গুলিস্তানে নটর ডেম কলেজের এক মেধাবী শিক্ষার্থীর মৃত্যু হয় এ ধরনের এক চালকের গাড়িচাপায়। ওই গাড়ির চালক হারুন অর রশিদ ছিলেন ডিএসসিসির একজন মাস্টাররোলের ক্লিনার। তার হাতেই ছিল ওই গাড়ির স্টিয়ারিং। গতকাল বৃহস্পতিবার কারওয়ান বাজারেও ঘটে এমন আরেকটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) একটি বর্জ্যবাহী গাড়ির নিচে চাপা পড়ে ঘটনাস্থলেই মারা যান সংবাদকর্মী আহসান কবির খান। ওই গাড়িটি চালাচ্ছিলেন মোহাম্মদ হানিফ নামের একজন বহিরাগত চালক। তিনি সিটি করপোরেশনের মাস্টাররোলের কোনো কর্মচারীও নন।
গতকাল দিনভর খোঁজ নিয়ে দুই সিটি করপোরেশনের পরিবহন শাখার সীমাহীন অব্যবস্থাপনা, অসঙ্গতি, অনিয়ম, বিশৃঙ্খলা- এক কথায় নৈরাজ্যকর অবস্থার চিত্র পাওয়া গেছে। বছরের পর বছর এই নৈরাজ্য বিরাজমান।
বহিরাগত চালক :ডিএসসিসির ভারী যানবাহন রয়েছে ৩৩৭টি। অথচ ভারী যানবাহনের চালক আছে মাত্র ৮৬ জন। বাকি চালকদের কারোরই ভারী যানবাহন চালানোর কথা নয়। প্রায় একই অবস্থা ডিএনসিসির। তাদের বর্জ্যবাহী ভারী যানবাহন রয়েছে ১৩৭টি। বিপরীতে চালক আছে মাত্র ৪১ জন। এরও আবার ২৫ জন মাস্টাররোলে। গতকাল কারওয়ান বাজারে হতভাগ্য আহসান কবিরকে যে গাড়িটি চাপা দিয়েছে, সেটা বছর দুয়েক আগে সরকার বর্জ্য অপসারণের জন্য যেরকম ১০টি করে কম্প্যাক্টর ভারী যানবাহন দুই সিটি করপোরেশনকে বরাদ্দ দিয়েছিল, তারই একটি। এসব গাড়ির প্রতিটির মূল্য অন্তত এক কোটি টাকা। ডিএনসিসিকে দেওয়া ওই ১০টি গাড়ির প্রত্যেকটিই চালায় বহিরাগত চালকরা। তাদেরকে প্রতিদিন ৫০০ করে টাকা দেওয়া হয়। ডিএসসিসির ১০টি কম্প্যাক্টরও চলছে প্রায় একইভাবে। এসব চালকের কোনো দায়বদ্ধতা নেই। ফলে একেবারেই বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালায় তারা।
নেতাদের ভাড়াটে চালক :পরিবহন চালকদের ডিএসসিসি ড্রাইভার্স ইউনিয়ন নামে একটি ইউনিয়ন রয়েছে। ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই ইউনিয়নের নেতাদের দু-একজন ছাড়া অন্যরা যে কবে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরেছে, তারা মনে করতে পারে না। দুই সিটিতে এরকম প্রভাবশালী চালক আছে দুই শতাধিক। তারা নিজে কখনোই গাড়ি চালায় না।
কোনো রকম গাড়ি চালাতে পারে বা যাদের হালকা যানের লাইসেন্স আছে- এরকম বহিরাগতদের সঙ্গে গাড়ি চালানোর চুক্তি করে। তাদেরকে মাসে ১০-১২ হাজার টাকা পরিশোধ করে। ওইসব চালকের হাতে তখন চলে যায় সিটি করপোরেশনের ভারী যানবাহনগুলো- বিশেষ করে বর্জ্যবাহী যানগুলো। ওই গাড়ির বিপরীতে যে পরিমাণ জ্বালানি ইস্যু হয়, ভাড়াটে চালকরা তার একটি অংশ চুরি করে বাইরে বিক্রি করে দেয় বা ফিলিং স্টেশনের সঙ্গে যোগসাজশ করে। এভাবে প্রতিদিন গড়ে ১০ লিটার জ্বালানি বিক্রি করলে তেল চুরিতেই মাসে তাদের আয় হয় ২৪-২৫ হাজার টাকা।
এদিকে, যারা এরকম ভাড়াটে চালক ভাড়া করে, তারা বেতন তোলে। পাশাপাশি সিটি করপোরেশন থেকে প্রতি মাসে বেতনের সমপরিমাণ টাকা ওভারটাইম নেয়। ফলে কোনো রকম গাড়ি না চালিয়েই তারা বসে বসে বেতন ও ওভারটাইমের টাকা পেয়ে যায়। তারা ইউনিয়নের রাজনীতি বা নিজস্ব ব্যবসায় সময় দেয়।
ত্রুটিপূর্ণ অর্গানোগ্রাম :২০১৬ সালে রাজধানীর দুই সিটি করপোরেশনের জন্য প্রণীত অর্গানোগ্রামে গাড়ি চালকের পদ আছে ৩০৬টি করে। এর মধ্যে ২১৫টি ভারী যানচালক ও ৯১ জন হালকা যানচালক। সিটি করপোরেশন চাইলেই এর চেয়ে বেশি যানচালক নিয়োগ দিতে পারে না। ফলে অতিরিক্ত গাড়ি চালানোর জন্য তখন মাস্টাররোলে নিয়োগ দেয় সিটি করপোরেশন। আবার এমন ঘটনাও ঘটেছে, ভারী যানবাহন চালকের জন্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও যোগ্য ভারী যানচালককে পায় না। ফলে অনেকটা বাধ্য হয়েই তখন হালকা যানচালক বা বহিরাগত বা ক্লিনার-মশককর্মীদের দিয়ে ওইসব যানবাহন চালাতে বাধ্য হয় কর্তৃপক্ষ। বছরের পর বছর এই জনবল কাঠামো সংশোধনের উদ্যোগ নেওয়া হয় না।
জ্বালানি চুরি :দুই সিটি করপোরেশনের কিছু গাড়ি সিএনজিচালিত। বাকিগুলো ডিজেল ও অকটেন বা পেট্রোলচালিত। বর্তমানে প্রতি বছর দুই সিটি করপোরেশনে জ্বালানি খরচ হয় প্রায় পাঁচ কোটি টাকা। যারাই জ্বালানি ইস্যুর দায়িত্বে থাকে, তাদের বিরুদ্ধে বরাবরই অভিযোগ চালক, জ্বালানি সরবরাহকারী ফিলিং স্টেশন ও পরিবহন শাখার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে জ্বালানি চুরির যোগসাজশের। যখনই জ্বালানির বিল বেড়ে যায়, তখনই বোঝা যায় জ্বালানি চুরির মাত্রা বাড়ছে। তখনই জ্বালানি ইস্যুকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ ওঠে। তখনই তাকে বদলি করে নতুন লোককে দায়িত্ব দেওয়া হয়। নতুন ব্যক্তি দায়িত্ব নেওয়ার পর কিছু দিন জ্বালানি খরচ কমে যায়। কয়েক মাস পর আবারও জ্বালানি ব্যয় বাড়তে থাকে। তখনই জ্বালানি চুরির বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। ফলে ঘন ঘন এ পদে পরিবর্তন আনা হলেও, মূলত অবস্থার কোনো পরিবর্তন ঘটছে না।
সরকারি যানবাহন (ব্যবস্থাপনা নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা-১৯৮৬-তে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, কোনো কর্মকর্তার জন্য বা কোনো প্রয়োজনে ব্যবহূত গাড়ি শুধু ওই চালকই চালাতে পারবেন। এমনকি কোনো কর্মকর্তা তার নামে বরাদ্দকৃত গাড়ি নিজে বা পরিবারের কোনো সদস্যও চালাতে পারবেন না।
এসব প্রসঙ্গে গতকাল দুই সিটি করপোরেশনের পরিবহন শাখার কেউ কথা বলতে রাজি হননি। তবে ডিএসসিসির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ফরিদ আহম্মদ এসব প্রসঙ্গে বলেন, ‘আমাদের পরিবহন শাখায় কিছু সমস্যা আছে। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য বর্তমান মেয়র দায়িত্ব নেওয়ার পর দুটি মিটিং হয়েছে। আমরা ধীরে ধীরে অসঙ্গতিগুলো কাটিয়ে আনার চেষ্টা করছি। অর্গানোগ্রামে যে সংখ্যক চালকের কথা উল্লেখ আছে, সেটা সংশোধনের জন্য সরকারের সঙ্গেও আলোচনা হয়েছে।’
তিনি বলেন, যে সংখ্যক ভারী যানবাহন রয়েছে, সে তুলনায় চালকের সংখ্যা অনেক কম। ফলে বাধ্য হয়েই হালকা যানবাহনের চালক দিয়ে কাজ চালাতে হচ্ছে। ৫০ জন ভারী যানচালক নিয়োগের জন্য তিন দফায় বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছিল। এর মধ্যে ৪১ জন আবেদন করেন। বিআরটিএতে পাঠলে দেখা যায়, মাত্র ১৯ জনের লাইসেন্স ঠিক আছে। বাকিগুলো জাল। ভারী যানবাহন চালানোর লাইসেন্সের নিয়ম বেশ কঠিন। এ বিষয়টি সংশোধনের জন্য বিআরটিএর সঙ্গেও কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আজও (গতকাল) এ বিষয়ে মেয়র মহোদয়ের সঙ্গে আমরা বিভাগীয় প্রধানরা মিটিং করেছি। আগামীকালও (আজ) মিটিং আছে। আমরা চেষ্টা করছি পরিবহন বিভাগকে একটি সুশৃঙ্খল অবস্থার মধ্যে আনার।’
বিশেষজ্ঞরা যা বলছেন :পরিবহন বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অধ্যাপক ড. এম শামসুল হক সমকালকে বলেন, সিটি করপোরেশনসহ সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়িগুলোর ফিটনেস, চালকের লাইসেন্স রয়েছে কিনা- এসব দেখভালের কেউ নেই। এই সুযোগে গাড়ির স্টিয়ারিং যে কারও হাতে চলে যায়। সিটি করপোরেশনের পরিবহন খাতে বহু দিন ধরে চরম বিশৃঙ্খলা। এখানে কঠোর আইনের প্রয়োগ নেই। সরকারি প্রতিষ্ঠানের গাড়ি এভাবে একের পর এক প্রাণহানির কারণ হলে, কেন শুধু চালক বা তার সহকারী দায়ী হবে? প্রতিষ্ঠানকে এর দায় নিতে হবে। কারণ তাদের তো অজানা নয়, এ খাতে কী ধরনের নৈরাজ্য চলছে। আর নগরপিতা নিজের প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল রেখে অন্যকে সব বিষয়ে আইন মানার কথা বলবেন- এই বৈপরীত্য হতাশাজনক। এখনই পরিবহন খাত ঘিরে বড় ধরনের সংস্কার না হলে হৃদয়বিদারক ঘটনা ঘটতে থাকবে। আমাদের ধাপে ধাপে উন্নত হওয়ার যে স্বপ্ন, তাতে বাধা হয়ে দাঁড়াবে এসব ট্র্যাজেডি।
ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মুনিবর রহমান সমকালকে বলেন, যেহেতু সিটি করপোরেশনের এ ধরনের গাড়িতে দুর্ঘটনা বাড়ছে, তাই ফিটনেসসহ চালকের লাইসেন্স রয়েছে কিনা- এসব ব্যাপারে ট্রাফিক পুলিশের তদারকি আরও বাড়ানো হবে। কোনো গাড়ি দুর্ঘটনার কারণ হলে আমরা সংশ্নিষ্টদের আইনের আওতায় নিয়ে আসি।
ময়লার গাড়িতে যত দুর্ঘটনা :গত ২ মে শাহজাহানপুরে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়িচাপায় পিষ্ট হয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের কেয়ারটেকার স্বপন আহামেদ দীপু (৩৩) নিহত হন। তিনি মোটরসাইকেল চালিয়ে যাচ্ছিলেন। নিহত দীপু পাবনা জেলার চাটমোহর উপজেলার দীঘল গ্রামের আতাহার হোসেনের ছেলে। মুগদার মা া খালপাড় এলাকায় থাকতেন।
গত ১৬ এপ্রিল যাত্রাবাড়ী থানার বিবির বাগিচা এলাকায় সকাল ৮টার দিকে সিটি করপোরেশনের আরেক বর্জ্যবাহী গাড়ির ধাক্কায় অজ্ঞাতপরিচয় এক রিকশাচালক নিহত হন। আহত হন রিকশার আরোহী হরেন্দ্র দাস (৭০)।
চলতি বছরের ২০ জানুয়ারি গেণ্ডারিয়ার দয়াগঞ্জ মোড়ে ডিএসসিসির গাড়ির ধাক্কায় প্রাণ যায় বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) টেলিফোন অপারেটর খালিদ মুন্নার (৫৫)। তিনি মোটরসাইকেলে পল্টনের অফিসে যাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পর ট্রাফিক পুলিশ গাড়িসহ চালককে আটক করে। পরে জামিনে বেরিয়ে আসেন চালক। গেণ্ডারিয়ার ওসি সাজু মিয়া বলেন, ওই মামলায় চার্জশিট দাখিল করা হয়েছে।
গত ৯ আগস্ট রাত ১টার দিকে রাজধানীর শ্যামপুরের ধোলাইরপাড় সাবান ফ্যাক্টরির গলি? এলাকায় রাস্তা পার হওয়ার সময় ময়লার গাড়ির ধাক্কায় ফারুক হোসেন (৪০) নামে এক পোশাককর্মী নিহত হন।
এর আগে ২০১৮ সালের ২৩ নভেম্বর রাত ১১টার দিকে রাজধানীর পুরান ঢাকার বকশীবাজার এলাকায়ও সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় নুরজাহান (২২) নামে এক মোটরসাইকেল আরোহীর মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়। ওই দুর্ঘটনায় নুরজাহানের স্বামী মোটরসাইকেল চালক মো. আসিফ আহত হন।
২০১৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর সবুজবাগ বৌদ্ধ মন্দিরের সামনে সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির নিচে চাপা পড়ে রিমন ও শারিন নামে দুই তরুণ-তরুণী নিহত হন।
এপ্রিলে রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর কাজলা এলাকায় ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ময়লাবাহী গাড়ির ধাক্কায় মো. মোস্তফা নামে এক রিকশাচালকের মৃত্যু হয়। এ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়ে স্থানীয় জনতা ওই সময় ময়লার গাড়িটিতে আগুন ধরিয়ে দেয়।
২০১৬ সালের ৩ মার্চ রাজধানীর উত্তরার হাউজ বিল্ডিং মোড়ে সিটি করপোরেশনের ময়লার ট্রাকের নিচে চাপা পড়ে আবুল কালাম আজাদ (৫০) নামে এক ব্যবসায়ীর মৃত্যু হয়েছে।-সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *