গত বছর উইসকনসিনের কেনোশোতে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে গুলি করে দুজনকে হত্যার দায়ে অভিযুক্ত কাইল রিটেনহাউসকে মামলা থেকে খালাস করে দেয়ার ঘটনায় যুক্তরাষ্ট্রের পোর্টল্যান্ড, বোস্টনসহ বিভিন্ন শহরে ব্যাপক সহিংসতা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে দাঙ্গা অবস্থা ঘোষণা করেছে পুলিশ।
উইসকনসিনে বর্ণবাদবিরোধী বিক্ষোভে গুলি চালিয়ে হত্যা করা কাইল রিটেনহাউসকে অব্যাহতি দেয়ার জেরে ফুঁসে উঠেছেন পোর্টল্যান্ডের মানুষ। দেশটির চলমান আইনি ব্যবস্থার নিন্দা জানিয়ে প্রতিবাদে রাস্তায় নেমে আসেন বিক্ষুব্ধরা।
এ সময় বেশ কয়েক জায়গায় নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে ধস্তাধস্তির ঘটনা ঘটে। কয়েক জায়গায় পুলিশকে লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছুঁড়ে মারেন আন্দোলনকারীরা। আইনি প্রতিষ্ঠানে চালানো হয় ভাঙচুর। বেশ কয়েক জায়গায় ব্যাপক সহিংসতার খবর পাওয়া গেছে।
পোর্টল্যান্ডের পাশাপাশি বোস্টনেও ন্যায় বিচারের দাবিতে শত শত মানুষ রাস্তায় নেমে আসেন। সবার সামনে বর্ণবাদবিরোধীদের ওপর গুলি করার পরও হত্যা মামলাসহ পাঁচটি অভিযোগ থেকে রিটেনহাউসকে অব্যাহতি দেয়ায় ক্ষোভ জানান তারা। বিক্ষোভ হয় মিনিয়াপোলিসেও।
গত বছরের আগস্ট মাসে উইসকনসিন অঙ্গরাজ্যের কেনোশা শহরে বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলন চলাকালে নিজের অস্ত্র দিয়ে গুলি চালান ১৭ বছর বয়সী কাইল রিটেনহাউজ। এতে ঘটনাস্থলেই দুইজন নিহত হন। আহত হন একজন। ঐ মামলার দীর্ঘ শুনানি শেষে শুক্রবার (২০ নভেম্বর) রায় ঘোষণা করা হয়। এতে নির্দোষ প্রমাণিত হন তিনি। হত্যাসহ ৫টি অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেয়া হয় তাকে।
আদালতের বিতর্কিত রায়ের পর দেশজুড়ে ক্ষোভ জন্মানো সাধারণ মার্কিনদের শান্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছে বাইডেন প্রশাসন। উইসকনসিনের আদালতের এ রায়ের মধ্য দিয়ে দেশটির অপরাধ বিষয়ক বিচার ব্যবস্থা সংস্কারের সময় এসেছে বলে মন্তব্য করেছেন মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস।
প্রথমে রায় মেনে নেয়ার আহ্বান জানালেও কয়েক ঘণ্টা পরেই রায়ের বিষয়ে ক্ষোভ জানান মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। মার্কিন রাষ্ট্রপতি একটি লিখিত বিবৃতি দিয়ে এই রায়ে হতাশা প্রকাশ করেন।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন যে, উইসকনসিনের কেনোশাতে গত বছর জাতিগত অস্থিরতার সময় দুইজনকে গুলি করে হত্যাকারী কিশোর রিটেনহাউসকে আদালত খালাস করে দেওয়ার পরে তিনি ক্ষুব্ধ হয়েছেন।
গত বছর নির্বাচনী প্রচারণার সময় জো বাইডেন একটি ভিডিও টুইট করেছিলেন, যাতে কোনও প্রমাণ ছাড়াই শ্বেতাঙ্গ আধিপত্যবাদীদের সঙ্গে রিটেনহাউসের যোগাযোগ রয়েছে বলে দাবি করা হয়।
২০২০ সালের ২৩ আগস্ট উইসকনসিনের কেনোশা শহরে জ্যাকব ব্লেক নামের এক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে পিঠে সাতবার গুলি করে পঙ্গু করে দেয় পুলিশ। এর বিরুদ্ধে ব্যাপক বিক্ষোভ চলাকালে ২৫ আগস্ট এই হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
প্রাক্তন পুলিশ যুব ক্যাডেট কাইল রিটেনহাউস জোসেফ রোজেনবাউম (৩৬) এবং অ্যান্থনি হুবার (২৬) নামের দুজনকে মারাত্মকভাবে গুলি করা এবং গেইজ গ্রোসক্রুটজ (২৮) নামের একজনকে আহত করার কথা স্বীকার করেন। তবে তার দাবি, তিনি আত্মরক্ষার জন্য এটি করেছিলেন। সেসময় কাইল রিটেনহাউস এর বয়স ছিল ১৭ বছর।
এর তিন মাস আগে মিনেসোটায় জর্জ ফ্লয়েড নামের আরেক কৃষ্ণাঙ্গ যুবককে নির্মমভাবে হত্যা করেছিল পুলিশ।
আত্মপক্ষ সমর্থন করে ১৭ বছর বয়সী রিটেনহাউস বলেছিলেন, বিক্ষোভ চলাকালে কয়েকজনের সঙ্গে বাকবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন তিনি। একপর্যায়ে তারা তাকে আক্রমণ করতে এলে তিনি নিজের কাছে থাকা আগ্নেয়াস্ত্র বের করেন এবং আত্মরক্ষার্থেই গুলি চালাতে বাধ্য হন। তিনি যাদেরকে গুলি করেছিলেন তারাও সবাই শেতাঙ্গ ছিলেন।
এ ঘটনার পর হত্যাসহ পাঁচটি অভিযোগ আনা হয় রিটেনহাউসের বিরুদ্ধে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হতো।
তার আইনজীবীরা তাকে একজন নাগরিক-মনস্ক কিশোর হিসাবে উপস্থাপন করেন, যিনি ব্যক্তিগত সম্পত্তি রক্ষার জন্য ওই মধ্য-পশ্চিম মার্কিন শহরে গিয়েছিলেন এবং নিজের প্রাণ বাঁচাতে শুধুমাত্র পুরুষদের গুলি করেছিলেন।
তবে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর অভিযোগ, রিটেনহাউসের কাছে থাকা অ্যাসল্ট রাইফেলটি ছিল অবৈধ। অস্ত্র বের না করলে হতাহতের ঘটনা ঘটতো না বলেও দাবি তার।
প্রথম নিহত রোজেনবাউম সেই রাতে অনিয়মিত আচরণ করেছিলেন এবং রিটেনহাউসকে তাড়া করে তার বন্দুকটি দখল করার চেষ্টা করেন। আর তখনই রিটেনহাউস তাকে মারাত্মকভাবে গুলি করে দেন।
দ্বিতীয় নিহত হুবার তখন রিটেনহাউসকে একটি স্কেটবোর্ড দিয়ে মাথায় বা ঘাড়ে আঘাত করলে তিনি তাকেও গুলি করে দেন।
এরপর গ্রসক্রুটজ নামের আরেক ব্যক্তি রিটেনহাউসের দিকে তার বন্দুক তাক করলে রিটেনহাউস তাকেও গুলি করে আহত করেন।
রিটেনহাউসের আইনজীবী মার্ক রিচার্ডস যুক্তি দেন যে, তার মক্কেল প্রথমে হামলা করেননি এবং নিজের জীবন বাঁচাতেই শুধু তিনি গুলি করেন।
রিটেনহাউসের গুলিতে নিহত দ্বিতীয় ব্যক্তি হুবারের বাবা-মা বলেছেন, এই রায়ে তাদের ‘হৃদয় ভেঙে গেছে’।
কারেন ব্লুম এবং জন হুবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, ‘এই রায় একটি অগ্রহণযোগ্য বার্তা পাঠায় যে, সশস্ত্র বেসামরিক ব্যক্তিরা যে কোনও শহরে হাজির হয়ে সহিংসতা উসকে দিতে পারে এবং তারপরে রাস্তায় লোকজনকে গুলি করার পক্ষে ন্যায্যতা তৈরি করার জন্য তারা নিজেরাই যে সহিংসতা উস্কে দিয়েছে সেটিকেই ব্যবহার করতে পারে’।
এই রায় মার্কিন সমাজের রাজনৈতিক বিভাজন উন্মোচিত করেছে। একদিকে, অনেক ডেমোক্র্যাট এই রায়ের নিন্দা করেছেন। অন্যদিকে, রিপাবলিকানরা বলছেন ন্যায়বিচার করা হয়েছে। এমনকি কেউ কেউ কাইল রিটেনহাউসকে ইন্টার্নশিপের প্রস্তাব দিয়েছেন।