সুন্দরবন-সংলগ্ন শ্রমজীবী মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খোঁজখবর নেওয়া ও নিজ চোখে বনবিবির পূজা দেখার জন্য আটজনের টিমে সুন্দরবনের উদ্দেশে রওনা হলাম ১৩ জানুয়ারি রাতে। সকালে মোংলা পৌঁছে আলোর কোল নামের ছোট্ট লঞ্চ ছুটালাম মোংলার কাছে ডাংমারি বন বিটের অন্তর্ভুক্ত লাউডুবের দিকে। কিন্তু লাউডুব পৌঁছে মানুষের মধ্যে কোনো উৎসব উৎসব ভাব না দেখে মনটা খারাপ হয়ে গেল। অবশেষে এক বাড়িতে ঢুকে বয়োবৃদ্ধ একজনকে জিজ্ঞেস করতেই আসল কাহিনি জানতে পারলাম।

আসলে নির্দিষ্ট তারিখের এক দিন আগে এসে পড়ায় এমনটা হয়েছে। কাজেই সারাটা দিন করমজল ঘুরে রাতটা ডাংমারির কাছে কাটিয়ে পরদিন সূর্য ওঠার পরপরই আবারও লাউডুবের দিকে রওনা হলাম। ক্যামেরা হাতে আমরা ক’জন লঞ্চের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। এমন সময় আমাদের বাম দিকের একটি খাড়ির পানিতে কিছু একটা নড়াচড়া করতে দেখলাম। দ্রুত লঞ্চের ইঞ্জিন বন্ধ করে ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে শাটারে আঙুল ছোঁয়ালাম। হঠাৎ প্রাণীটি পানি থেকে মাথা তুলল। সঙ্গে সঙ্গে শাটারে আঙুলের চাপ বেড়ে গেল। ভোরবেলার প্রথম শিকার (ছবি শিকার) পেয়ে প্রত্যেকেই ক্যামেরায় ক্লিকের বন্যা বওয়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। একটি নয়, দুটি নয়; একে একে চারটি বিরল ও বিপন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণী পানি থেকে মাথা তুলে উৎসুক দৃষ্টিতে চারদিকে তাকাতে লাগল। একসময় ওরা পানি থেকে কাদামাটিতে উঠল। আমাদের ক্যামেরায়ও ক্লিকের শব্দ বেড়ে চলল। বেশ খানিকক্ষণ সময় দিয়ে ধীরে ধীরে বাদা বনের গহিনে হারিয়ে গেল। আমরাও লঞ্চের ইঞ্জিন চালু করে বনবিবির পূজা দেখার জন্য লাউডুবের দিকে এগিয়ে চললাম।

এতক্ষণ বিপন্ন যে স্তন্যপায়ী প্রাণীগুলোর কথা বললাম ওরা হলো ছোটো উদ বা ভোঁদড় (Oriental Small-clawed Otter, Asian Small-clawed Otter বা Short-clawed Otter)। উদ্‌বিড়াল, ধাইড়া উদ বা ধেড়ে নামেও পরিচিত। বাংলাদেশে প্রাপ্ত তিন প্রজাতির ভোঁদড়ের মধ্যে ওরাই সবচেয়ে ছোট। তাছাড়া ওরাই বিশ্বের ক্ষুদ্রতম উদ প্রজাতি। কিন্তু অতীব দুঃখের ব্যাপার হলো, আমাদের কারণে ইতোমধ্যে প্রাণীগুলো এ দেশে বিপন্ন প্রাণীর তালিকায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছে। যা হোক, মাস্টেলিডি পরিবারভুক্ত এই প্রাণীর বৈজ্ঞানিক নাম অড়হুী Aonyx cinerea। বাংলাদেশ ছাড়া দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার বেশ কিছু দেশে ওদের দেখা মেলে।

ছোট উদের মাথা ছোট, পা খাটো ও লেজ চ্যাপ্টা। দেহের দৈর্ঘ্য ৪৫-৬১ সেন্টিমিটার (সেমি) ও লেজ ২৫-৩৫ সেমি। ওজন ২.৭-৫.৪ কেজি। লম্বাটে দেহটি যেন খাটো পায়ের ওপর স্থাপিত। সামনের পা দুটো পেছনের পা থেকেও খাটো। দেহের ওপরের লোমের রং গাঢ় ধূসর-বাদামি। মাথা ও ঘাড়সহ দেহের নিচটা হালকা ক্রিমরঙা। নখগুলো একেবারেই ছোট, কদাচ আঙুলের দৈর্ঘ্য পার হয়। থাবা আংশিক পাতাযুক্ত। লেজ বেশ লম্বা, দেহের দৈর্ঘ্যের প্রায় এক-তৃতীয়াংশ।

ছোট উদ অগভীর স্বাদুপানির জলপ্রবাহ ও নদী, উপকূলীয় অঞ্চল এবং বাদা বনের পানিতে বিচরণ করে। তবে বর্তমানে মূলত সুন্দরবনেই দেখা যায়। এরা দিবাচর, তবে সান্ধ্যচারীও হতে পারে। সাধারণত ছায়াযুক্ত এলাকা পছন্দ করে। একাকী, জোড়ায় ও ছোট পারিবারিক দলে থাকে। পছন্দের খাদ্যতালিকায় রয়েছে কাঁকড়া, খোলসি মাছ (ঝিনুক ও মাশেল), নরম শরীরবিশিষ্ট প্রাণী ও ছোট মাছ। এদের দৃষ্টিশক্তি প্রখর; পানির নিচেও ওপরের মতোই সমান দেখে। খাবার গ্রহণের সময় ডাকাডাকি করে। খাবার খোঁজার জন্য হাতই বেশি ব্যবহার করে, যা অন্যান্য প্রজাতির ভোঁদড়ের ক্ষেত্রে তেমন একটা দেখা যায় না। বিপদ আঁচ করতে পারলে পেছনের দু’পায়ের ওপর ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে চারদিকটা সাবধানে দেখে নেয়।

ওরা সারাজীবনের জন্য জোড়া বাঁধে। বছরের যে কোনো সময় প্রজনন করতে পারে। পুরুষ ছোট উদ বাসা বানানো ও বাচ্চার খাবার জোগাড়ে স্ত্রীকে সাহায্য করে। প্রতি জোড়া উদ বছরে দু’বার ও প্রতিবারে এক থেকে ছয়টি করে বাচ্চা দিতে সক্ষম। তবে সচরাচর দুটি করে বাচ্চাই জন্ম দেয়। স্ত্রীর গর্ভধারণকাল প্রায় ৬০ দিন। বাচ্চাদের জন্ম ওজন গড়ে ৫০ গ্রাম। জন্মের ৪০ দিন পর বাচ্চারা চোখ খোলে। প্রায় ৮০ দিন পর দুধ ছাড়ে ও শক্ত খাবার খাওয়া শুরু করে। ওদের পারিবারিক বন্ধন বেশ মজবুত। আগের বছরের বাচ্চারা নবজাতক বাচ্চা পালনে মা-বাবাকে সাহায্য করে। ওরা ১১-১৬ বছর বাঁচে। সূত্র: সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *