যমজ ভাই হাসান ও হোসাইন। রাজধানীর ক্যান্টনমেন্ট জেনারেল হাসপাতালে চলতি মাসের ৩ তারিখে তাদের জন্ম। জন্মের চার দিন পরই হোসাইন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়। বাড়ির বদলে তার আশ্রয় হয় ঢাকা শিশু হাসপাতালের ১২ নম্বর ওয়ার্ডের ৮ নম্বর শয্যায়। সেখান থেকে নেওয়া হয় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রে (আইসিইউ)। কঠিন লড়াই শেষে মায়ের কোলে চেপে বাসায় ফিরে গেছে ২২ দিনের হোসাইন। তবে তিন মাস ২৭ দিন বয়সী আহমাদ ফিরতে পারেনি। আইসিইউ থেকে লাইফ সাপোর্টে। এরপর গত শনিবার রাত সোয়া ৩টার দিকে মারা যায় সে।

গতকাল মঙ্গলবার কথা হয় হোসাইনের ফুফা সুলতান আহমেদের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘জন্মের দু’দিন পরই হোসাইনের মধ্যে কিছু সমস্যা দেখতে পাই। এ ছাড়া জ্বরও ছিল। শরীরের রং কখনও খুব কালচে লাগত। কখনও লাল রং ধারণ করত। পরে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হলে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। উপায় না পেয়ে আমরা শিশু হাসপাতালে ভর্তি করাই। এখন অনেকটা ভালো, তাই বাড়ি নিয়ে যাচ্ছি।’

এখানে কথা হয় স্যালাইন লাগানো ডেঙ্গু রোগী পাঁচ বছর বয়সী জুঁইয়ের বাবা লতিফুল রহমানের সঙ্গে। তিনি জানান, চার দিন জ্বরে আক্রান্ত ছিল তার মেয়ে। পরে জ্বর ভালোও হয়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করেই শরীরের তাপমাত্রা কমে গেছে। তাই আবার চিকিৎসকের কাছে গেলে রক্ত পরীক্ষা দেন। পরে জানা যায়, জুঁইয়ের ডেঙ্গু হয়েছে।

ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে গত ২৪ ঘণ্টায় এ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ছয় শিশু। তাদের মিলে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৬৩টি শিশু এখানে চিকিৎসাধীন। এর মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি সাত শিশু। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জানায়, জানুয়ারি থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত এ হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসা নিয়েছে ৩৮৩ শিশু। মারা গেছে সাত শিশু। ভর্তিকৃত শিশুর মধ্যে ৬১ দশমিক ৮০ শতাংশ রোগী ছেলে শিশু এবং ৩৮ দশমিক ২০ শতাংশ মেয়ে শিশু।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাস থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে রোগী ভর্তি হচ্ছে। তবে আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়তে থাকে। দ্বিতীয় সপ্তাহে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা কিছুটা কমলেও তৃতীয় সপ্তাহে এসে আবার ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, আগস্ট মাসের প্রথম ২২ দিনে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন পাঁচ হাজার ৩৮৩ জন। আর জানুয়ারি থেকে এ পর্যন্ত হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন আট হাজার ৪১ জন। অর্থাৎ এ সময়ের মধ্যে মোট আক্রান্তের ৬৭ ভাগই হয়েছেন চলতি মাসের ২২ দিনে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের হিসাবে চলতি বছর দেশে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৮ জন। এখনও হাসপাতালে ভর্তি আছেন এক হাজার ৭৭ জন। তাদের মধ্যে ঢাকার সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি আছেন ৯৮৮ জন। ডেঙ্গু আক্রান্তদের শতকরা ৫০ ভাগই শিশু।

শেরেবাংলা নগরের শিশু হাসপাতালের ‘ডেঙ্গু সেলে’ কথা হয় শিশু সাদিয়ার বাবা খলিলের সঙ্গে। তিনি জানান, মেয়েকে বাঁচানোর জন্য বিভিন্ন হাসপাতাল ঘুরে শিশু হাসপাতালে ভর্তি করানোর সুযোগ পেয়েছি। মেয়েকে আইসিইউতে নেওয়ারও পরামর্শ দিয়েছেন চিকিৎসকরা।

এই সেলে চিকিৎসা নিচ্ছে দুই ভাই ৯ মাস বয়সী সাঈদ ও পাঁচ বছরের আসাদ। তাদের মামা আইয়ুব বলেন, ‘গুলশানের বাসিন্দা তারা। সাত দিন ধরে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন ছিল সাঈদ। সোমবার তাকে ওয়ার্ডে দেওয়া হয়েছে। আগের চেয়ে অনেকটা ভালোর দিকে।’

সেলের সিনিয়র স্টাফ নার্স শাপলা আক্তার জানান, ডেঙ্গু রোগীর চাপ সামলাতে এই সেল করা হয়। এখানে ভর্তিকৃত অনেক রোগী ডেঙ্গু জ্বর নিয়ে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি হয়।

২৫.২৮ ভাগ শিশুই মিরপুরের :ঢাকা শিশু হাসপাতালের এপিডেমিওলজিস্ট অ্যান্ড রিসার্চ শাখার সর্বশেষ জরিপে দেখা যায়, ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের ১১৩টি এলাকায় ডেঙ্গু জ্বরের বাহক এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। এসব এলাকায় আক্রান্ত হয়ে এ হাসপাতালে মোট ৩৫৬ রোগী ভর্তি হয়েছেন। এসব এলাকার মধ্যে ঢাকার মিরপুরে ২৫ দশমিক ২৮ শতাংশ, রামপুরায় ৫ দশমিক ৬২ শতাংশ, কল্যাণপুর ২ দশমিক ৮১ শতাংশ, আগারগাঁও এবং মোহাম্মদপুরে ২ দশমিক ৫৩ শতাংশ শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে। এ ছাড়া ব্রাহ্মণবাড়িয়া, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ ও গাজীপুরেও ডেঙ্গু আক্রান্ত বেশি বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের রোগতত্ত্ববিদ কিংকর ঘোষ বলেন, ২০১৯-২০ সালের ডেঙ্গুর ধরনের চেয়ে এবার অনেকটা ভিন্ন। গত বছর ডেঙ্গুর লক্ষণ ছিল প্রথমে জ্বর আসে। জ্বর থাকার পর শিরা-উপশিরা ছিদ্র হয়ে পল্গাজমাগুলো বেরিয়ে যেত। এক পর্যায়ে তারা শকে চলে যায়। কিন্তু এবার আগের সমস্যার পাশাপাশি রোগীরা হূৎপিণ্ডে ও মস্তিস্কে সমস্যা নিয়ে আসছে। একে বলে এক্সপান্ডেড ডেঙ্গু সিনড্রোম। তিনি বলেন, পাঁচ থেকে ১০ বছর বয়সী শিশুদের মধ্যেই বেশিরভাগ শিশু ডেঙ্গু আক্রান্ত হচ্ছে।

ঢাকা শিশু হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. সৈয়দ শাফি আহমেদ বলেন, ডেঙ্গু এখন পুরো রাজধানীতে ছড়িয়ে পড়েছে। একথা অস্বীকার করার কিছু নেই। প্রথমে জ্বর আসে। তিন থেকে চার দিন জ্বর থাকতে পারে। আবার ভালো হয়েও যেতে পারে। তবে জ্বর থাকলে প্রথম ২৪ থেকে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে এনএসওয়ান ও সিভিসি করি। তবে জ্বর কমলেও পরবর্তী দু-একটা দিন সতর্ক থাকতে হবে। সূত্র: সমকাল

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *