মুম্বইয়ের বরিভেলিতে ‘সত্যম শিবম সুন্দরম’ নামে একটি লাক্সারি অ্যাপার্টমেন্ট কমপ্লেক্সের প্রধান ফটকের বাইরের রাস্তায় লিখে দেওয়া হয়েছে ‘নো কিসিং জোন’। লিখেছে সত্যম শিবম সুন্দরমের বাসিন্দারাই। তারা অনেক দিন থেকে তাদের বারান্দা, বা জানালা থেকে লক্ষ্য করছে তরুণ-তরুণীরা রাস্তাটির কিনারে বিকালে বা সন্ধেয় বাইকে বা গাড়িতে বসে পরস্পরকে চুমু খাচ্ছে। এই প্রেমের দৃশ্য সহ্য করা তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না, তাই পাবলিকের রাস্তায় প্রাইভেট লোকেরা নিজের হাতে আইন তুলে নিয়েছে। লিখে দিয়েছে ‘এখানে চুম্বন নিষিদ্ধ’।

ধরা যাক রাস্তাটিতে কোনও এক লোক আরেক লোকের প্রতি ঘৃণা ছুড়ে দিচ্ছে, গালিগালাজ করছে, কেউ কাউকে চড় থাপড় দিচ্ছে, লাথি দিচ্ছে, লাঠিপেটা করছে, পেটাতে পেটাতে রক্তাক্ত করে ফেলছে। তখন কী করবে অ্যাপার্টমেন্টের লোকেরা? তারা কি রাস্তায় বেরিয়ে গিয়ে লিখে আসবে ‘নো হেটিং জোন’? না, লিখবে না। তারা, আমার বিশ্বাস, বারান্দায় বা জানালায় ভিড় করে মারামারির দৃশ্য উপভোগ করবে।

রাস্তাঘাটে সরকার নিষেধাজ্ঞা ঝুলিয়ে দেয়, এখানে ধূমপান নিষিদ্ধ, মদ্যপান নিষিদ্ধ, থুতু ফেলা নিষিদ্ধ, প্রস্রাব করা নিষিদ্ধ, মলত্যাগ করা নিষিদ্ধ। এসব নিষিদ্ধের কাতারে কিছু লোক চুম্বনকে ফেলেছে, যে চুম্বন ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ! মানুষ ভালোবাসা এবং এর অভিব্যক্তিকে, এর সব রকম প্রকাশকে অশ্লীলতা বলে রায় দিচ্ছে, সে আজ থেকে নয়। সারা দেশের অধিকাংশ লোক আজ চুম্বনের নিষেধাজ্ঞার পক্ষে দাঁড়িয়েছে। মাঝে মাঝে অবাক হই যে দেশে আদিকালে কামসূত্রের মতো অসামান্য গ্রন্থ রচিত হয়েছে, কামের চৌষট্টি কলার নিখুঁত বর্ণনা করা হয়েছে, যে দেশে কামকলা পাথরে খোদাই করে দেখানো হয়েছে দেশের ইলোরা-অজন্তার গুহায়, খাজুরাহোর মন্দিরে, কোনারকের মন্দিরে, সে দেশের লোকের মধ্যে এই ভয়াবহ রক্ষণশীলতা কোত্থেকে এলো!

 

Bangladesh Pratidinকেউ কেউ বলে ঔপনিবেশিক আমলে ব্রিটিশরাই ভারতে আমদানি করেছে যে চরম ভিক্টোরীয় রক্ষণশীলতা, সেটি আজও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে। নিজের উদারতা বিসর্জন দিয়ে অন্যের রক্ষণশীলতা গ্রহণ করা দুঃখজনক। কিন্তু এটিই এখনকার বাস্তবতা। ধর্মবাদ, মৌলবাদ, জাতীয়তাবাদ, ঐতিহ্যবাদ ইত্যাদি মানুষকে পাঁকে ডুবিয়ে ফেললে ওই একই পরিণতি ঘটে; ব্যক্তি-স্বাধীনতাকে ছুড়ে ফেলে রক্ষণশীলতাকে, অনুদারতাকে, অনাধুনিকতাকে আলিঙ্গন করতে হয়।

মুম্বইয়ের ঘটনার পর ভারতীয়রা একটি মতবাদ বেশ দ্রুত পরিবেশন করছে, ‘আজ যদি রাস্তাঘাটে চুম্বন ঘটতে থাকলে বাধা না দেওয়া হয়, তাহলে চুম্বনের পরবর্তী পর্ব যৌনসঙ্গমও রাস্তাঘাটে ঘটতে থাকবে। তখন নরকে পরিণত হবে গোটা দেশ।’  এই ভয় যত বেশি দেখায় তারা, তত বেশি তাদের দলে লোক ভিড় করে। ‘কালেকটিভ কনজারভেটিভনেস’ তখন বিশাল আকারে বিরাজ করতে থাকে।

জনসমক্ষে প্রেম ভালোবাসার প্রকাশ ঠিক কতখানি হওয়া উচিত, কতদূর একে মানা যায়, কোথায় গিয়ে থামতে হয়, এসব নিয়ে বিস্তর আলোচনা হচ্ছে আজকাল। এই প্রশ্নটি তারাই করে, যারা চুম্বনকে, হাতে হাত ধরে হাঁটাকে, আলিঙ্গন করাকে যৌনসঙ্গম বলে মনে করে। আমি চুম্বনকে চুম্বন হিসেবে দেখি, মানুষের তা-ই দেখা উচিত। চুম্বনে বাধা না দেওয়া হলে তারা যেখানে সেখানে শুয়ে পড়বে, আমার তা মনে হয় না। যে সব দেশে প্রকাশ্য চুম্বনে বাধা নেই, সেসব দেশে কি নর-নারী ভিড়ের রাস্তায় যৌনসঙ্গমে লিপ্ত হচ্ছে? না, একটিও এমন ঘটনা ঘটেনি। তাহলে আশঙ্কাটি অমূলক শুধু নয়, আশঙ্কাটি জেনে বুঝে মানুষকে বিভ্রান্ত করার জন্য তৈরি।

সুইডেনের আরলান্ডা এয়ারপোর্টে সিকিউরিটি চেকের সামনে একসময় বড় একটি জায়গাকে দাগ দিয়ে আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। জায়গাটির নাম দেওয়া হয়েছিল ‘কিসিং জোন’। মানুষ মানুষকে গভীর চুম্বন করে বিদেয় জানাতো। কিসিং জোনটি দেখতে আমার বেশ ভালো লাগতো। মানুষ মানুষকে ভালোবাসছে, এই দৃশ্য আমাকে সবসময় মুগ্ধ করে। যাদের মুগ্ধ করে না, তারা মানুষ হিসেবে নিশ্চয়ই খুব অনুদার, খুব নিষ্ঠুর, খুব স্বার্থপর। অনুদার আর নিষ্ঠুর আর স্বার্থপর মানুষের সংখ্যা, খুবই পরিতাপের বিষয় যে, পৃথিবীতে বেশি।

ইউরোপ, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডের রাস্তাঘাটে, বাসে, ট্রেনে, সিনেমা থিয়েটারে, বারে রেস্টুরেন্টে প্রেমিক প্রেমিকা চুমু খাচ্ছে, এতে কারও চোখ জ্বালা করে না। আমার কিছু ইউরোপীয় বন্ধু জ্যোৎস্না রাতে চলে যায় সমুদ্র তীরে, অরণ্যে, পাহাড়ে; প্রকৃতির মাঝে প্রেমিক-প্রেমিকার যৌনসঙ্গম, তারা বিশ্বাস করে, যেমন পবিত্র তেমন সুন্দর। তারা বিশ্বাস করে, ঘরের চার দেওয়ালের ভেতর থেকে বের হওয়া মনের জন্যই শুধু দরকারি নয়, শরীরের জন্যও দরকারি। ওদিকে পৃথিবীর প্রায় সব মুসলিম দেশেই জনসমক্ষে চুম্বন নিষেধ। মধ্যপ্রাচ্যের কিছু দেশ তো চুম্বনকে গুরুতর অপরাধ হিসেবে দেখে। সেসব দেশে অবশ্য প্রকাশ্যে মানুষের ধড় থেকে মুন্ডু কেটে নেওয়া অপরাধ নয়। শুধু মুসলিম দেশে নয়, চীনের মতো দেশেও প্রকাশ্যে চুম্বন অপরাধ। গণতন্ত্রের গলা টিপে ধরলে জনগণের ব্যক্তিস্বাধীনতাগুলো এক এক করে মুখ থুবড়ে পড়তে থাকে।

বাংলাদেশের মাঠে ময়দানে পার্কে বাগানে ছেলেমেয়েরা ঘনিষ্ঠ হয়ে বসলে, হাতে হাত রাখলেই এলাহি কান্ড ঘটে যায়। একবার দেখেছিলাম কোনও এক ম্যাজিস্ট্রেট ভ্রাম্যমাণ আদালত বসিয়ে ছেলেমেয়েদের শাস্তি দিলেন কারণ তারা একটি পার্কে পাশাপাশি বসে কথা বলছিল। একমাত্র অসভ্য দেশগুলোতেই প্রেম-ভালোবাসাকে অপরাধ এবং অশ্লীল বলে গণ্য করা হয়।

আমি কিন্তু প্রেম ভালোবাসার প্রকাশকে, সে ঘরে হোক বাইরে হোক, অশ্লীল বলে মনে করি না। আমার কাছে কী অশ্লীল এবং কী অশ্লীল নয় তা উল্লেখ করছি। কাউকে গালি দেওয়া, পেটানো, চড় থাপড় লাগানো, ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেওয়া, ঘুসি দেওয়া, লাথি দেওয়া, পেটে পিঠে ছুরি বসানো, গলা কেটে ফেলা, গুলি করা, কারও বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামা-এসব ‘অশ্লীল’। অন্যদিকে, কাউকে ভালোবাসা, আলিঙ্গন করা, আদর করা, সোহাগ করা, চুম্বন করা, কারও সঙ্গে প্রেম করা, যৌনসম্পর্ক করা-এসব ‘অশ্লীল নয়’।

দুঃখ এই, যা আসলে অশ্লীল, তাকে ‘অশ্লীল নয়’ বলে ধরে নেওয়া হয়, আর যা ‘অশ্লীল নয়’, তাকে অশ্লীল বলে বিচার করা হয়। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত-উপমহাদেশের সর্বত্র একই মানসিকতার লোক। ধর্ম, সংস্কৃতি এবং ভাষা তাদের ভিন্ন হতে পারে, কিন্তু মানসিকতা এক এবং অভিন্ন।

অশ্লীলতা বিষয়ে এই উপমহাদেশের হিন্দু আর মুসলমান মৌলবাদীদের মধ্যে আমি বিন্দুমাত্র পার্থক্য দেখি না। তারা একই রকম কট্টর রক্ষণশীল, একই রকম অনুদার তারা, একই রকম নারীর সমানাধিকার বিরোধী। নারীকে ঘরবন্দী করতে, পুরুষের সেবাদাসী করতে, পরনির্ভর করতে উভয়ের উৎসাহ প্রচন্ড। তারা নারীর সমস্ত রকম স্বাধীনতার ঘোর বিরোধী, সবচেয়ে বেশি বিরোধী নারীর যৌন স্বাধীনতার। নারী পুরুষের চুম্বনে, তারা মনে করে, নারীর যৌন স্বাধীনতার প্রকাশ হয়। চুম্বনকে সে কারণেই তারা মেনে নিতে পারে না। কারণ তাদের মতে, যৌনদাসীদের যৌনস্বাধীনতা থাকে না, থাকতে নেই। ভায়োলেন্স যেসব দেশে স্বাভাবিক, সেসব দেশে চুম্বন অস্বাভাবিক। প্রতিনিয়ত ঘরে বাইরে নির্যাতিত হচ্ছে, ধর্ষণ আর খুনের শিকার হচ্ছে মেয়েরা। এমন পরিস্থিতিতে যখন ভালোবেসে কিছু পুরুষ কিছু মেয়েকে আলিঙ্গন করে বা চুম্বন করে, সেটিকে স্বাগত না বলে যদি হঠিয়ে দেওয়া হয়, এর অর্থ তো একটিই দাঁড়ায়, মেয়েরা ভালোবাসার যোগ্য নয়, তাদের এড়িয়ে চলো, উপেক্ষা করো, অবজ্ঞা করো, ঘৃণা করো। নারীবিদ্বেষীরা দুনিয়ার সকল নারীকে অচ্ছুৎ বলেই মনে করে।

আমাদের এই উপমহাদেশে নারীবিদ্বেষীর সংখ্যা আশংকাজনকভাবে বেশি। ধর্মান্ধতা আর মৌলবাদ বাড়লে নারীবিদ্বেষ বাড়ে। নারীবিদ্বেষ বাড়লে ধর্ষণ আর নারীহত্যা বাড়ে। আমরা তো সমাজের দিকে একবার তাকালেই নারীবিদ্বেষী বীভৎস সব চিত্র দেখতে পাই।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *