শরণার্থী ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রূপরেখায় আশ্রিত দেশে শরণার্থীদের রেখে দেওয়ার প্রসঙ্গটি নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আগেভাগে জানত না। ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের সহায়তায় জাতিসংঘের সম্পৃক্ততা নিয়ে আলোচনার সময় গত জুন মাসে ওই রূপরেখা সম্পর্কে মন্ত্রণালয় প্রথমবারের মতো জানতে পারে। এরপর জুলাইতে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ বিশ্বব্যাংকের শরণার্থী নীতির রূপরেখার বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মতামত চায়।

রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসনে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে জড়িত সরকারি কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শরণার্থীদের সহায়তার লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কার্যক্রম পরিচালনার এমন একটি রূপরেখা নিয়ে বিশ্বব্যাংক ও জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা (ইউএনএইচসিআর) দুই রকম বক্তব্য দিচ্ছে।

বিশ্বব্যাংক মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, রোহিঙ্গাদের বিষয়ে বাংলাদেশকে সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সুপারিশ তারা করেনি। মিয়ানমার থেকে প্রাণের ভয়ে পালিয়ে আসা সংখ্যালঘু এই মুসলমান জনগোষ্ঠীর জন্য বাংলাদেশকে সহায়তায় বিশ্বব্যাংক কাজ করছে। আর শরণার্থীদের ব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশ্বব্যাংকের রিফিউজি পলিসি রিভিউ ফ্রেমওয়ার্ক-আরপিআরএফ শীর্ষক রূপরেখার যে পর্যালোচনা, সেটি জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্যের ভিত্তিতে তৈরি করা হয়েছে।

এ বিষয়ে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সরকারের দুই জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা এই প্রতিবেদককে জানান, ভাসানচরের কাজে যুক্ততা নিয়ে সমঝোতা স্মারকের দর–কষাকষির সময় জাতিসংঘ প্রথমবারের মতো বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কাছে বিশ্বব্যাংকের আরপিআরএফের কপি সরবরাহ করে। ওই দলিলে বিশ্বব্যাংক স্পষ্ট করেই লিখেছে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার তথ্য, উপাত্ত ও মতামতের ভিত্তিতে ওই রূপরেখার দলিলটি প্রণীত হয়েছে। এমনকি ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের মৌলিক অধিকার সুরক্ষার কথা বলতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের ওই রূপরেখার প্রসঙ্গ টেনেছেন জাতিসংঘের কর্মকর্তারা।

বিশ্বব্যাংকের রূপরেখা-সংক্রান্ত দলিলটিতে বলা হয়েছে, ২০২০ সালের জুলাই পর্যন্ত শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী যে ১৬ দেশে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জন্য প্রকল্পে স্বল্প সুদের ঋণসহায়তা দিয়েছে ওই তালিকায় বাংলাদেশও রয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংক মঙ্গলবার তাদের বিবৃতিতে বলেছে, বাংলাদেশের জন্য যে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি আছে, তা ঋণ নয়, অনুদান।
মতামত চেয়েছে বিশ্বব্যাংক

বিশ্বব্যাংকের বাংলাদেশের প্রধান মার্শি টেম্বন সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে দেওয়া এক চিঠিতে বলেন, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সচিবের সঙ্গে তাঁর আরপিআরএফের (শরণার্থী নীতি পর্যালোচনার রূপরেখা) বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। এ বিষয়ে ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে মতামত না পেলে বিশ্বব্যাংক ধরে নেবে যে, তাদের প্রস্তাবে বাংলাদেশের আপত্তি নেই।

এর পরিপ্রেক্ষিতে ৮ জুলাই ইআরডি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ ৯টি মন্ত্রণালয়ের কাছে চিঠি দিয়ে বিশ্বব্যাংকের শরণার্থী ব্যবস্থাপনার রূপরেখা মেনে ঋণ নেওয়া যায় কি না, সে বিষয়ে মতামত জানতে চায়। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় নির্ধারিত সময়ে তাদের মতামত ইআরডিতে পাঠায়।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও ইআরডি সূত্র জানিয়েছে, সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের মতামত পাওয়ার পর আরপিআরএফের বিষয়ে বাংলাদেশ চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে।

বিশ্ব ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, আরপিআরএফের বিষয়ে মতামত পেতে ৩১ জুলাইয়ের পর সময়সীমা আরও দুই সপ্তাহ বাড়ানো হয়েছে। জানা গেছে, রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহায়তায় বিশ্ব ব্যাংক বাংলাদেশকে যে ৫৯০ মিলিয়ন ডলার দিচ্ছে তা পাঁচটি প্রকল্পে চলমান রয়েছে।

এ বিষয়ে পররাষ্ট্রসচিব মাসুদ বিন মোমেন গত ২৯ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘এখানে আমাদের অবস্থান খুব স্পষ্ট। বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে সহায়তা নিতে গিয়ে এমন কোনো প্রস্তাব মানার সুযোগ নেই, যা বাংলাদেশের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে। তাই ১৮ জুলাইয়ের নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগে (ইআরডি) আমরা মতামত পাঠিয়েছি। এখন এ নিয়ে আমরা ইআরডির সঙ্গে আলোচনা করতে চাই।

কারণ, এ রকম একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে শুধু চিঠি দিয়ে মতামত দেওয়াটা যথেষ্ট মনে করছি না। রোহিঙ্গাদের অন্তর্ভুক্তকরণের বিষয়ে জাতিসংঘ বা বিশ্বব্যাংক চিন্তা করতে পারে, কিন্তু আমরা পারি না।’
আরপিআরএফে কেন সম্মতি নয়

বিশ্বব্যাংকের শরণার্থী রূপরেখার বিষয়ে ইআরডি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে মতামত চেয়েছিল। ইআরডির কাছে পাঠানো মতামতে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতিসংঘের ওই রূপরেখার তিনটি উদ্দেশ্যের বিষয়ে আপত্তি তুলেছে। এগুলো হচ্ছে শরণার্থী ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সামাজিক উন্নয়নের সুযোগ সৃষ্টি, শরণার্থীদের আশ্রয়দানকারী দেশে টেকসইভাবে আর্থসামাজিক অন্তর্ভুক্তিকরণ অথবা মাতৃভূমিতে প্রত্যাবর্তনের মাধ্যমে দীর্ঘায়িত শরণার্থী সমস্যার টেকসই সমাধানে সহায়তা এবং অধিকতর শরণার্থীর সম্ভাব্য আগমনের বিষয় সামনে রেখে আশ্রয়দানকারী দেশের প্রস্তুতি।

সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের অনেকের মতে, অনেক বছর ধরে রোহিঙ্গাদের জন্য উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়ার চেষ্টা বেড়ে গেছে, যা থেকে মনে হতে পারে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে আত্তীকরণকে উৎসাহিত করা হচ্ছে। এমন এক পরিস্থিতিতে কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থায়নের সুদূরপ্রসারী পর্যালোচনার জন্য সব পক্ষকে যুক্ত করে কারিগরি ও আইনি বিষয়গুলো পর্যালোচনার জন্য দ্রুত আলোচনা করাটা জরুরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *