রাজধানীর মিরপুর থেকে দেশি-বিদেশি ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ভুয়া প্রতিনিধি পরিচয় দেওয়া প্রতারক ইশরাত রফিক ঈশিতা (আইপিসি) ও তার সহযোগী শহিদুল ইসলাম দিদারকে আটক করেছে র্যাব-৪। রোববার ভোরে অভিযান চালিয়ে তাদের আটক করে র্যাব।
র্যাব জানায়, ইশরাত ফিলিপাইনের একটি ওয়েবসাইট থেকে ৪০০ ডলারে সামরিক বাহিনীর মতো ‘বিগ্রেডিয়ার জেনারেল’ র্যাঙ্ক পদটি কিনে সেই র্যাঙ্ক ব্যাচ ও পোশাক বানিয়েছিলেন। তার সহযোগী শহিদুলও একই প্রতিষ্ঠান থেকে ‘মেজর জেনারেল র্যাঙ্ক’ পদ কিনেছিলেন। ইশরাত ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ অর্গানাইজেশন, কাউন্টার ক্রাইম ইন্টেলিজেন্স অর্গানাইজেশনের সদস্য পদের ভুয়া সনদ তৈরি করে প্রচারণা চালাচ্ছিলেন। ভুয়া ডিগ্রি, পদ-পদবি ব্যবহার করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ও আইপি চ্যানেলে নিজের প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। তাছাড়া বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ হিসেবে টকশোতে অংশগ্রহণ করতেন। বিশেষ করে ভুয়া সার্টিফিকেট, এডিটিং ছবি, মিথ্যা বিবৃতি ও তথ্য প্রদানের মাধ্যমে সবাইকে বিভ্রান্ত করতেন।
এছাড়া মানবাধিকার লঙ্ঘন, নারী শিশু অধিকার, চিকিৎসা বিজ্ঞান, করোনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচক হিসেবে নিজের প্রচারণা চালাচ্ছিলেন।
রোববার বিকেলে কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলনে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন জানান, ঈশিতার বাসা থেকে ভুয়া আইডি কার্ড, ভুয়া ভিজিটিং কার্ড, সিল, ভুয়া সার্টিফিকেট, প্রত্যয়নপত্র, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, ৩০০ পিস ইয়াবা, পাঁচ বোতল বিদেশি মদ, পাসপোর্ট, ল্যাপটপ, বিগ্রেডিয়ার জেনারেল পদের দুটি ইউনিফর্ম ও র্যাঙ্ক ব্যাচ উদ্ধার করা হয়েছে।
মঈন বলেন, ইশরাত পেশায় একজন চিকিৎসক। তিনি ময়মনসিংহের একটি বেসরকারি মেডিকেল কলেজ থেকে ২০১৩ সালে এমবিবিএস সম্পন্ন করেন। ২০১৪ সালের শুরুর দিকে মিরপুরের একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসক হিসেবে যোগ দেন। ওই বছরই একটি সরকারি সংস্থায় চুক্তিভিত্তিক চিকিৎসক হিসেবে নিয়োগ পান। চার মাস চাকরির পর শৃঙ্খলাজনিত কারণে চাকরিচ্যুত হন। এরপর থেকে তিনি প্রতারণা শুরু করেন। চিকিৎসাশাস্ত্রের বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষক হিসেবে পরিচয় দিতেন। যেমন- এমপিএইচ, এমডি, ডিও ইত্যাদি। তাছাড়া ক্যানসার বিশেষজ্ঞ হিসেবেও নিজের প্রচারণা চালাতেন।
র্যাব মুখপাত্র বলেন, করোনা মহামারিকে পুঁজি করে ভার্চুয়াল জগতে প্রতারণায় সক্রিয় ছিলেন ইশরাত। অনলাইনে করোনা প্রশিক্ষণ কোর্সের আয়োজন ও সার্টিফিকেট দিয়ে প্রচার-প্রচারণা চালাতেন। বিদেশি ভুয়া সার্টিফিকেট প্রচার করে অর্থের বিনিময়ে সার্টিফিকেট গ্রহণে আকৃষ্ট করতেন।
ঈশিতা ‘ইয়ং ওয়ার্ল্ড লিডারস ফর হিউম্যানিটি’ নামক একটি অনিবন্ধনকৃত ও অননুমোদিত সংগঠন চালাচ্ছিলেন। যার সদরদপ্তর নিউইয়র্কে অবস্থিত বলে প্রচার করতেন। যদিও ফেসবুকে এই পেজের কো-এডমিন ছিলেন ইশরাত। এই পেজের মাধ্যমে দেশে ও আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে প্রতারণা নেটওয়ার্ক তৈরি করেছিলেন। নেপাল, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, ভারত, আমেরিকা, নাইজেরিয়া, ওমান, সৌদি আরব এসব দেশে অর্থের বিনিময়ে প্রতিনিধি নিয়োগ করেন। এসব দেশে সংগঠনের ব্যানারে সেমিনার অ্যাওয়ার্ড প্রদান ও প্রশিক্ষণের আয়োজন করেন। যেখানে অর্থের বিনিময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিদের অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়।
র্যাব কর্মকর্তা বলেন, ভুয়া অ্যাওয়ার্ডের মাধ্যমে অর্জিত অর্থ ইশরাত ও তার প্রধান সহযোগী দিদার ভাগ করে নিতেন। ২০১৯ সালে রাজধানীর একটি অডিটোরিয়ামে ৩০ জন ‘ইয়ং ওয়ার্ল্ড লিডারস ফর হিউম্যানিটিকে সম্মাননা জানানো হয়। অনুষ্ঠানে ইশরাত সঞ্চালক ছিলেন। অনুষ্ঠানটি গ্রহণযোগ্য করতে বিভিন্ন ব্যক্তিদের ব্যক্তিদের ছবি যুক্ত করে অ্যাডভাইজর, ভাইস চেয়ারম্যান, ইন্টারন্যাশনাল ভাইস চেয়ারম্যানসহ নানা পদে দায়িত্ব পালন করত বলে প্রচারণা চালাতেন।
২০২০ সালে ঈশিতা ভারতের উত্তর প্রদেশে হোটেল পার্ক অ্যাসেন্টে অনুষ্ঠিত জিআইএসআর ফাউন্ডেশনের প্রদত্ত ইন্টারন্যাশনাল ইন্সপিরেশনাল ওমেন অ্যাওয়ার্ড (আইআইডবিউ ২০২০) পেয়েছেন বলে প্রচার করেন। যা ৩৫ বছর বয়সী চিকিৎসা বিজ্ঞানী ও গবেষকদের মধ্যে ‘বছরের সেরা নারী বিজ্ঞানী’ পুরস্কার হিসেবে বিবেচিত। এছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতে ‘রিসার্চ অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ ভারতের ‘টেস্ট জেম অ্যাওয়ার্ড ২০২০’ থাইল্যান্ডে আন্তর্জাতিক শিক্ষা সম্মেলনে অংশ নিয়ে ‘আউটস্ট্যান্ডিং সায়েন্টিস্ট অ্যান্ড রিসার্চার অ্যাওয়ার্ড’ ইত্যাদি পেয়েছেন বলেও দাবি করেছেন ঈশিত। তবে এসবই ভুয়া। এসব অনুষ্ঠানের ছবি এডিট করে নিজের ছবি বসিয়ে দিতেন।
র্যাব জানায়, তিনি প্রতারণার মাধ্যমে ভুয়া নথি উপস্থাপন করে ২০১৮ সালে জার্মানিতে ‘লিন্ডা ও নোবেল লরিয়েট মিট-মেডিসিনে’ অংশ নেন। পরে তিনি প্রচারণা চালান যে, তিনি প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ওই অনুষ্ঠানে যোগ দেন। তবে ওই অনুষ্ঠানে তিনি কোনও পুরষ্কার পাননি। তিনি সেখানে গিয়ে ছবি তুলেছেন। ঈশিতা বিশ্বের ৬০ থেকে ৬৫ টি দেশ ভ্রমণ করেছেন বলে দাবি করলেও তিনি শুধু জার্মানিতে গিয়েছিলেন। অ্যাম্বাসেডর হিসেবে আমেরিকান সেক্সুয়াল হেলথ অ্যাসোসিয়েশন, ন্যাশনাল সার্ভিকাল ক্যান্সার কোয়ালিশনে কাজ করছেন বলেও দাবি করতেন ঈশিতা। তবে এগুলোর সবই ভুয়া।
কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, ইশরাতের বস হিসেবে পরিচয় দিতনে সহযোগী শহিদুল। তিনি ২০১২ সালে ডিপ্লোমা ইনস্টিটিউট থেকে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেন। পরে তিনি পোস্ট গ্রাজুয়েশন ডিপ্লোমা করেছেন। তিনি একটি গার্মেন্টেসে ম্যানেজার হিসেবে কাজ করতেন। নিজেকে আইন সহায়তা কেন্দ্র (আসক), ইয়াং ওয়ার্ল্ড লিডার কর হিউমিনিটিসহ বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে পরিচয় দিতেন। একইভাবে তিনি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থার দূত বা অ্যাম্বাসেডর পরিচয় দিতেন। এভাবে দেশে ও বিদেশে প্রতারণা, চাঁদাবাজির মাধ্যমে বিপুল অর্থ কামিয়েছেন।