এত দিন অনলাইনের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন খাতে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রাপাচারের বিষয়টি আলোচনায় ছিল। এখন ই-বাণিজ্যের আড়ালে বিদেশে অর্থপাচার হওয়ারও আশঙ্কা করা হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে সবার আগে আসছে দেশের অন্যতম শীর্ষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির নাম। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ‘গাঢাকা’ দেওয়ার আশঙ্কা থেকে এরই মধ্যে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান ও ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে দুদক। অনুসন্ধানে কাজ করছে দুদকের সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরীর নেতৃত্বে দুই সদস্যের টিম। টিমের অন্য সদস্য হলেন উপসহকারী পরিচালক মুহাম্মদ শিহাব সালাম।
এদিকে অনলাইনভিত্তিক সহস্রাধিক প্রতিষ্ঠানের বিজ্ঞাপন দিতে গিয়েও পাচার হয়ে যাচ্ছে বিপুল অঙ্কের বৈদেশিক মুদ্রা—এমনটাই আশঙ্কা করছে বিভিন্ন মহল। তবে সরকারের কোনো দপ্তর জানে না এই খাতে কত টাকা রাজস্ববঞ্চিত হচ্ছে দেশ। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, গুগল, ফেসবুক, ইউটিউব, ইমো, হোয়াটসঅ্যাপসহ যোগাযোগের বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিজ্ঞাপন দিতে গিয়ে বছরে হাজার কোটির বেশি টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। অথচ এই খাত থেকে সরকার রাজস্ব পাচ্ছে না এক টাকাও।
বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন রেগুলেটরি কমিশন (বিটিআরসি) সূত্র বলছে, গত দুই বছরে ইন্টারনেটভিত্তিক মাধ্যমে বিজ্ঞাপন দেওয়ার প্রবণতা অনেকাংশেই বেড়েছে। বিশেষ করে কভিড-১৯ পরিস্থিতিতে অনলাইনের ব্যবহার বেড়ে যায়। এতে স্বাভাবিকভাবে অনলাইনের দিকেই ঝুঁকে পড়ে বিজ্ঞাপনদাতা প্রতিষ্ঠানগুলো।
ই-কমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) সভাপতি শমী কায়সার কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী সেলকে বলেছেন, দেশে শুধু ই-ক্যাবে নিবন্ধিত আছে দেড় হাজার প্রতিষ্ঠান। এর বাইরে আরো অনেক প্রতিষ্ঠান, এমনকি ব্যক্তিপর্যায়ে ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা গড়ে উঠেছে। পরিস্থিতি বিবেচনায় তাঁদের প্রায় প্রত্যেকেই অনলাইননির্ভর। তাঁরা প্রতিনিয়ত বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞাপন দিয়ে যাচ্ছেন। করোনার কারণে অনলাইন মার্কেট আগের তুলনায় অনেক বড় হয়েছে।
অনলাইনে ব্যবসা এবং প্রচার দুটোই সমান্তরালে বাড়ছে। প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগের পাশাপাশি ফেসবুকে কয়েক লাখ নারী উদ্যোক্তার অংশগ্রহণে দেশীয় পণ্যের শক্তিশালী ভিত্তি গড়ে উঠেছে ই-বাণিজে। বাংলাদেশে এই খাতের বাজার দেড় বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে, যা চলতি বছর দুই বিলিয়ন এবং ২০২৩ সালে তিন বিলিয়ন ডলার ছাড়ানোর তথ্য দিয়েছে জার্মানভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান স্ট্যাটিস্টা। ক্রমেই ই-বাণিজ্যে ঝুঁকে পড়ছেন বেশির ভাগ ভোক্তা। ওষুধ, পোশাক, গয়না, ইলেকট্রনিকসামগ্রী, কসমেটিকস, সবজি, খাদ্যদ্রব্যসহ সব ধরনের পণ্য কেনাকাটা চলছে অনলাইনে। ফলে প্রতারণা ঠেকাতে এই খাতটির প্রতি নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের।
এদিকে দেশের অন্যতম শীর্ষ ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির ক্ষেত্রে আশঙ্কা করা হচ্ছে সরাসরি অর্থপাচারের। দুদক কমিশনার মো. মোজাম্মেল হক খান কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী সেলকে বলেন, ‘ইভ্যালির গ্রাহকদের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে এরই মধ্যে দুদক ইভ্যালির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার বিদেশ গমনে নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। কারণ ইভ্যালির বিরুদ্ধে দুদকের অনুসন্ধান শুরু হয়ে গেছে। অনুসন্ধানে আমরা ইভ্যালি গ্রাহকদের কাছ থেকে অগ্রিম টাকা নিয়ে কী করেছে? এটা জানব। এ ছাড়া অগ্রিম নেওয়া এসব অর্থ মানি লন্ডারিং করে কোথাও পাচার করা হয়েছে কি-না তা-ও খুঁজে দেখব। গ্রাহকের অর্থ পাচার করা হলে ইভ্যালির বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে মামলা দায়ের করা হবে।’ তিনি জানান, ইভ্যালির বিরুদ্ধে দুটো অভিযোগ তাঁরা এক সঙ্গে খতিয়ে দেখছেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল কালের কণ্ঠ’র অনুসন্ধানী সেলকে বলেন, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সুপারিশ অনুযায়ী ইভ্যালির বিরুদ্ধে সব আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এরই মধ্যে তাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়ে যাওয়ার কথা। কোনো কারণে না হলেও দ্রুততম সময়ের মধ্যে মামলা হবে। এরপর আইনি প্রক্রিয়ায় বিষয়টি অনুসন্ধান করা হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গত ১৪ মার্চে ইভ্যালির মোট সম্পদ ৯১ কোটি ৬৯ লাখ ৪২ হাজার ৮৪৬ টাকা (চলতি সম্পদ ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা) এবং মোট দায় ৪০৭ কোটি ১৮ লাখ ৪৮ হাজার ৯৯৪ টাকা। ওই তারিখে গ্রাহকের কাছে ইভ্যালির দায় ২১৩ কোটি ৯৪ লাখ ছয় হাজার ৫৬০ টাকা এবং মার্চেন্টের কাছে দায় ১৮৯ কোটি ৮৫ লাখ ৯৫ হাজার ৩৫৪ টাকা। গ্রাহকদের অগ্রিম এবং মার্চেন্টদের কাছ থেকে মালামাল নেওয়ার পর স্বাভাবিক নিয়মে প্রতিষ্ঠানটির কাছে ৪০৩ কোটি ৮০ লাখ এক হাজার ৯১৪ টাকার চলতি সম্পদ থাকার কথা থাকলেও প্রতিষ্ঠানটির সম্পদ রয়েছে মাত্র ৬৫ কোটি ১৭ লাখ ৮৩ হাজার ৭৩৬ টাকা।
প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়, এই পরিস্থিতিতে প্রায় ৮৪ শতাংশ গ্রাহক এবং মার্চেন্টের পাওনা পরিশোধ করার সক্ষমতা নেই ইভ্যালির। এ ক্ষেত্রে গ্রাহক ও মার্চেন্টের কাছ থেকে গৃহীত ৩৩৮ কোটি ৬২ লাখ ১৮ হাজার ১৭৮ টাকা আত্মসাৎ কিংবা অবৈধভাবে অন্যত্র সরিয়ে ফেলার আশঙ্কা রয়েছে।