দেশে করোনাভাইরাসের টিকা দুই ডোজই সম্পন্ন হয়েছে এখন পর্যন্ত মোট জনগোষ্ঠীর মাত্র সাড়ে ৩ শতাংশের। আর প্রথম ও দ্বিতীয় ডোজ মিলে প্রায় এক কোটি ডোজ টিকা দেওয়া হয়েছে। দেশকে হার্ড ইমিউনিটির স্তরে নেওয়ার জন্য শুরুতে করোনার টিকা দেওয়ার পরিকল্পনা করা হয়েছিল মোট জনসংখ্যার ৮০ শতাংশ মানুষকে। রোগতত্ত্বের দৃষ্টিকোণ থেকে সেই পরিকল্পনা থাকলেও প্রবাসী ও অনূর্ধ্ব ১৮ বছর বয়সীদের বাদ দিয়ে ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রায় এখন বেশি জোর দেওয়া হচ্ছে।
এদিকে টিকা ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনায় জড়িত ব্যক্তিরা বলছেন, দেরি হলেও কোভ্যাক্স ও সেরাম থেকে ৪০ শতাংশ মানুষের টিকা পাওয়ার চুক্তি ও প্রতিশ্রুতি রয়েছে। ফলে সেটি পাওয়া নিশ্চিত, তবে সময় হয়তো প্রত্যাশার চেয়ে দীর্ঘায়িত হতে পারে। তাঁদের তথ্য অনুসারে দেশে টিকা পরিকল্পনা বাস্তবায়নে মূল ভরসাই হচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সমন্বিত গ্রুপ কোভ্যাক্স, যেখান থেকে বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে ২০ শতাংশ মানুষের টিকা। এ ছাড়া কিনে আনা যাবে আরো ১১ শতাংশ মানুষের জন্য। সেরাম থেকে ৯ শতাংশ মানুষের টিকা পাওয়ার ক্রয়চুক্তি রয়েছে। বাকি টিকা জোগাড় হচ্ছে চীন, রাশিয়াসহ অন্যান্য মাধ্যম থেকে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকা কার্যক্রমে যুক্ত সূত্রগুলোর তথ্য অনুসারে এ পর্যন্ত দেশে টিকা এসেছে সেরাম থেকে কেনা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার ৭০ লাখ ডোজ; একই প্রতিষ্ঠানে তৈরি একই টিকার আরো ৩২ লাখ ডোজ ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে উপহার দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে চীন সরকারের পক্ষ থেকে উপহার পাওয়া গেছে সিনোফার্মের পাঁচ লাখ ডোজ টিকা এবং আজ রবিবার রাতে কোভ্যাক্স থেকে প্রথম চালানের এক লাখ ৬২০ ডোজ আসছে ফাইজারের উৎপাদিত টিকা।
ওই সূত্রের তথ্য অনুসারে, আরো প্রক্রিয়ায় আছে চীনের উপহারের ছয় লাখ ডোজ, চীনের কাছ থেকে কেনা হচ্ছে দেড় কোটি ডোজ এবং রাশিয়ার কাছ থেকে কেনা হচ্ছে দেড় কোটি ডোজ। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউরোপের একাধিক দেশ থেকেও টিকা পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। বেসরকারিভাবেও কয়েক লাখ ডোজ টিকা কেনার উদ্যোগ চলছে জোরেশোরে। পাশাপাশি দেশে টিকা উৎপাদনে রাশিয়া ও চীনের সঙ্গে কাজ এগিয়ে চলছে। সব মিলিয়ে এই জুন মাসে প্রায় দুই কোটি ডোজ টিকা দেশে আসার সম্ভাবনা রয়েছে, যার মধ্যে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সংকট থাকা অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকাও থাকছে বলে সূত্র জানায়।
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় গঠিত জাতীয় কারিগরি উপদেষ্টা কমিটির সিনিয়র সদস্য ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ডা. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘মহামারি মোকাবেলায় মোট জনসংখ্যা হিসাব করতে হলে টিকা কার্যক্রম চলার সময় দেশে উপস্থিত মোট জনসংখ্যাকে আনতে পারলে হার্ড ইমিউনিটি স্তরে যেতে সাফল্য মিলবে। তবে টিকা একই সময়ে না দিলে কিংবা কিংছু অংশ দেওয়া হলো, বাকিদের দেওয়া হলো না—এমনটা করলে লাভ না-ও হতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘ফাইজারের যে টিকা আসছে সেটা যেহেতু ১২ বছর পর্যন্ত শিশুদেরও দেওয়া যাবে, তাই এই টিকা দিয়ে আমাদের দেশে শিশুদেরও, বিশেষ করে ১২-১৮ বছরের শিশুদেরও টিকায় যুক্ত করা যেতে পারে।’
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের টিকাদান কার্যক্রমের পরিচালক ডা. শামসুল হক বলেন, হার্ড ইমিউনিটি নিশ্চিত করতে মোট জনগোষ্ঠীর ৮০ শতাংশের মধ্যে অ্যান্টিবডি তৈরি করা দরকার হয়। ওই ৮০ শতাংশের প্রভাবে বাকি ২০ শতাংশ মানুষের এমনিতেই হার্ড ইউমিউনিটি তৈরি হয়ে পুরো জনগোষ্ঠীর সংক্রমণ থেকে সুরক্ষা মিলবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ১৭ কোটি জনসংখ্যা হিসাবে দেশকে করোনাভাইরাস প্রতিরোধী করতে ১৪ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। তবে এখন সার্বিক বিবেচনায় বিদেশে থাকা মানুষ ও শিশুদের বাদ দিয়ে ১০ কোটি মানুষকে টিকা দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা ঠিক করা হয়েছে।
এই কর্মকর্তা টিকার জোগান বিষয়ে বলেন, দেশে টিকার সবচেয়ে বড় জোগান আসবে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও গ্লোবাল ফান্ডের সমন্বিত কোভ্যাক্স গ্রুপ থেকে। এ ক্ষেত্রে কোভ্যাক্স থেকে প্রথম ধাপে বিনা মূল্যে পাওয়া যাবে মোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ বা তিন কোটি ৪০ লাখ মানুষের জন্য ছয় কোটি ৮০ লাখ ডোজ টিকা; যার মধ্যে রবিবার রাতে প্রথম লটে আসছে এক লাখ ৬২০ ডোজ। এ ছাড়া কোভ্যাক্স থেকে আরো ১১ শতাংশ মানুষের জন্য টিকা কিনে আনার সুযোগ নিয়ে রেখেছে বাংলাদেশ। সেরামের সঙ্গে ক্রয়চুক্তি হয়েছে ৯ শতাংশ বা দেড় কোটি মানুষের টিকার, যার মধ্যে ৭০ লাখ ডোজ পাওয়া গেছে। সেই হিসাবে শুধু কোভ্যাক্স আর সেরাম থেকে পাওয়া যাবে মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ মানুষের টিকা। বাকিগুলো অন্য সব মাধ্যম থেকে পাওয়া যাবে। সে প্রক্রিয়া চলছে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সূত্র জানায়, শুরুতে নিশ্চিত কোনো পরিকল্পনায় না থাকলেও টিকা জোগাড় করার নানা প্রক্রিয়ায় সরকারের চেষ্টার অংশ হিসেবে এরই মধ্যে উপহার হিসেবে ভারত সরকারের কাছ থেকে পাওয়া গেছে ৩২ লাখ ডোজ, চীন থেকে উপহার পাওয়া গেছে পাঁচ লাখ ডোজ, চীন থেকে আরো ছয় লাখ ডোজ উপহারের প্রতিশ্রুতি রয়েছে। এ ছাড়া রাশিয়ার কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ ও চীনের কাছ থেকে দেড় কোটি ডোজ টিকা কেনার প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত। এর বাইরে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা ও ইউরোপের কোনো কোনো দেশ থেকেও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের টিকা পাওয়ার ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। পাশাপাশি বেসরকারি উদ্যোগেও টিকা আনার কাজ চলছে। অন্যদিকে দেশেই রাশিয়া ও চীনের টিকা উৎপাদনের বিষয়টিও অনেকটাই চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে।
সূত্রগুলো জানায়, এসব প্রক্রিয়ার পাশাপাশি ভারতের সরকারি প্রতিষ্ঠান ভারত বায়োটেক ও ফ্রান্সভিত্তিক প্রতিষ্ঠান সানোফি পাস্তুরের টিকার বিষয়েও কিছু প্রক্রিয়া চলছে। পাশাপাশি বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গ্লোব ফার্মাসিউটিক্যালসের সহযোগী প্রতিষ্ঠান গ্লোব বায়োটেকের টিকার ট্রায়াল অনুমোদনের জন্য ঝুলে আছে বিএমআরসিতে।
এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের এমআইএস শাখার সর্বশেষ তথ্য অনুসারে দেশে গতকাল শনিবার পর্যন্ত করোনাভাইরাসের টিকার প্রথম ডোজ (অক্সফোর্ডের) দেওয়া হয়েছে ৫৮ লাখ ২০ হাজার ১৫ জনকে। একই টিকার দ্বিতীয় ডোজ নিয়েছেন ৪১ লাখ ৪২ হাজার ২৫৫ জন। এ ছাড়া গতকাল পর্যন্ত চীনের সিনোফার্মের টিকার প্রথম ডোজ নিয়েছেন এক হাজার ২৩৯ জন। সব মিলিয়ে এ পর্যন্ত দেশে টিকা দেওয়া হয়েছে ৯৯ লাখ ৬৩ হাজার ৫০৯ ডোজ। এখন টিকা হাতে আছে অক্সফোর্ড ও সিনোফার্মেরসহ মোট সাত লাখ ৩৫ হাজার ডোজের মতো। – কালের কণ্ঠ