দেশের ১৮ জেলার ৩০ সীমান্ত পয়েন্ট এখন আগ্নেয়াস্ত্র সংগ্রহ ও কেনাবেচার খোলা বাজারে পরিণত হয়েছে। সেসব স্থানে অস্ত্রশস্ত্র প্রদর্শন ও কেনাবেচা চলছে প্রায় প্রকাশ্যেই। দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে ব্যবসায়ীরা সীমান্ত পয়েন্টের অস্ত্র-মাদকের খোলা বাজারগুলোয় নিয়মিত ভিড় করছে। কভিড-১৯-এর বিস্তারজনিত সংকট ও আতঙ্কের অস্থিরতায় ঢিলেঢালা নিরাপত্তাব্যবস্থার সুযোগে সীমান্ত পয়েন্টগুলো দিয়ে বানের পানির মতো অবাধে আসছে অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ। বিভিন্ন সীমান্ত পয়েন্ট গলিয়ে ঢুকে পড়ছে বিপুল আগ্নেয়াস্ত্রের চালান।

হাতবোমা, চকলেট বোমা, টুটু বোর, রিভলবারের চালান আনা হচ্ছে মুড়িমুড়কির মতো। এসব অস্ত্রশস্ত্র বিভিন্ন অপরাধী নেটওয়ার্কের মাধ্যমে রাজধানীসহ সারা দেশেই ছড়িয়ে পড়ছে। আগ্নেয়াস্ত্রের সহজলভ্য ছড়াছড়ি থাকায় ছোট আকারের দ্ধন্ধ-বিরোধেও এর অবাধ ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা মাঝেমধ্যেই অভিযান চালান, ধরপাকড় করেন। অস্ত্র-মাদকের ছোট ছোট চালানও আটক হয়। কিন্তু বন্ধ হয় না হাটবাজার।
চলতি বছরের শুরুর দিকে একটি গোয়েন্দা সংস্থা তাদের মাঠ পর্যায়ের অনুসন্ধান শেষে প্রস্তুতকৃত প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, দেশজুড়ে অস্ত্রশস্ত্র সহজলভ্য হয়ে পড়েছে এবং বেশ কিছু পয়েন্টে অস্ত্র কেনাবেচা চলছে প্রায় প্রকাশ্যেই। অন্য একটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনেও বলা হয়, দেশের বিভিন্ন সীমান্তের অন্তত ২৬টি পয়েন্ট দিয়ে ছোট আকার-আকৃতির নানারকম অস্ত্রশস্ত্রের পাশাপাশি নাইন এমএমসহ আরও অত্যাধুনিক ও লেটেস্ট মডেলের মারাত্মক ধরনের অস্ত্রশস্ত্রও অবাধে ঢুকে পড়ছে। এসব পয়েন্টে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), সীমান্ত থানার পুলিশ ও বিভিন্ন গোয়েন্দা নজরদারি নিশ্চিত করতে ইতিপূর্বে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকেও বিশেষ নির্দেশনা জারি করা হয়। তার পরেও কয়েকটি সীমান্ত পয়েন্ট এখনো অস্ত্র আমদানি ও বেচাকেনার বিপজ্জনক স্থান হিসেবে পরিণত হয়ে আছে।

কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া, রামু, কুমিল্লার সদর, সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবা, চাঁপাইনবাবগঞ্জের সদর ও শিবগঞ্জ, রাজশাহীর গোদাগাড়ী, পবা, চারঘাট, বাঘা, নাটোরের লালপুর, কুষ্টিয়ার দৌলতপুর, দিনাজপুরের হিলি, দেশমা, সাতক্ষীরার কালীগঞ্জ, ভোমরা, সিলেটের জকিগঞ্জ ও জাফলং সীমান্ত পয়েন্ট সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিজিবির ডিউটি পোস্ট ও টহল দলের সংখ্যা বাড়িয়েও অস্ত্র সংগ্রহের সীমান্ত পয়েন্টগুলো পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে রাখা যাচ্ছে না।

অতিসম্প্রতি একটি গোয়েন্দা সংস্থার দেওয়া প্রতিবেদনেও শেরপুর-জামালপুরের দুর্গম পাহাড়ি সীমান্তের কয়েকটি পয়েন্টকে অস্ত্রশস্ত্র-গোলাবারুদ পাচারের স্পর্শকাতর স্থান হিসেবে চিহ্নিত রয়েছে। সীমান্ত পয়েন্টে অবস্থানকারী সন্ত্রাসী চক্র তাদের অস্ত্রশস্ত্র লেনদেন, বেচাকেনা ও পাচার কাজে রাজনৈতিক মাঠের পরিচিত কিছু নেতা-কর্মীকে সহায়ক শক্তি হিসেবে ব্যবহার করছে বলেও অভিযোগ রয়েছে। গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনটিতে গারো পাহাড়ি সীমান্তের পয়েন্টগুলো ছাড়াও কক্সবাজারের উখিয়া, মহেশখালী দ্বীপ, চকোরিয়া এবং চট্টগ্রামের পতেঙ্গা ও আনোয়ারা উপজেলার গহিরা সমুদ্রঘেঁষা স্থানকে অস্ত্রশস্ত্র খালাসের বড় পয়েন্ট বলে চিহ্নিত করা হয়েছে। অন্যদিকে সিলেটের জকিগঞ্জ, মৌলভীবাজারের কুলাউড়া-বড়লেখা ও কমলগঞ্জ সীমান্তের ১৬টি স্থান অস্ত্র ও মাদক আনা-নেওয়ার সহজ পয়েন্ট হয়ে উঠেছে। অস্ত্রশস্ত্র অত্যাধুনিক ও ঝকঝকে : রাজধানীসহ দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়ছে নতুন ঝকঝকে চকচকে আগ্নেয়াস্ত্র। সংঘবদ্ধ একাধিক চক্র বিভিন্ন দেশ থেকে অবৈধ পথে প্যাকেটজাত অস্ত্রের চালান এনে ছড়িয়ে দিচ্ছে হাতে হাতে। মাঠপর্যায়ে বিভিন্ন অভিযানে সম্পৃক্ত থাকা র‌্যাব, পুলিশ, গোয়েন্দা কর্মকর্তারাও স্বীকার করে জানিয়েছেন, গত দুই বছরে উদ্ধারকৃত আগ্নেয়াস্ত্রের বেশির ভাগই ছিল নতুন চকচকে। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একজন উপ-কমিশনার বলেছেন, ‘আগে বিভিন্ন অভিযানে ভাঙাচোরা, পুরনো এবং দেশে তৈরি পাইপগান মার্কা অস্ত্রশস্ত্রই বেশি পাওয়া যেত। কিন্তু ইদানীং সন্ত্রাসীদের হাতে উঠে এসেছে অপেক্ষাকৃত ছোট আকৃতির এবং অধিক ক্ষমতাসম্পন্ন আর্মস।’ তিনি আরও জানান, কয়েকটি বিশেষ রাষ্ট্র থেকে প্যাকেটজাত এ অস্ত্রশস্ত্র এনে দেশজুড়ে বেচা করা হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট একাধিক গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তা ও মাঠপর্যায়ে চোরাচালান কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন সূত্রের সঙ্গে যোগাযোগ করে এসব বিপজ্জনক অস্ত্র লেনদেনের স্পট চিহ্নিত করা গেছে। অনুসন্ধানে জানা যায়, হবিগঞ্জের সাতছড়ি, শেরপুরের গাজনী, দিনাজপুরের হিলিসহ হাকিমপুর-ফুলবাড়ী, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাটের প্রত্যন্ত পাহাড়ি সীমান্ত, সাতক্ষীরার কলারোয়া ও সুন্দরবন নদী সীমান্ত, মৌলভীবাজারের শরীফপুর সীমান্ত পয়েন্ট, রাজশাহীর বেড়পাড়া, টাঙ্গন, নওদাপাড়া, ইউসুফপুর সীমান্ত পয়েন্টে এখন আগ্নেয়াস্ত্রের অবাধ আনা-নেওয়া ও কেনাবেচা চলছে। নওদাপাড়া-কাটাখালী অঞ্চলের চিহ্নিত চোরাকারবারি ও সীমান্ত ঘাট পরিচালনাকারী এক প্রভাবশালীর নেতৃত্বাধীন ফাইভ স্টার গ্রুপের দুর্বৃত্তরা মাদক চোরাচালানের পরিবর্তে এখন অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্র আমদানি ও কেনাবেচায় বেশি ব্যস্ত। সেখানে মাত্র ২০-২২ হাজার টাকায়ই ভারতীয় পিস্তল, হালকা রিভলবার জাতীয় অস্ত্রশস্ত্র কেনাবেচা চলে বলে একটি প্রতিবেদনে স্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে। রাজধানীর প্রান্তসীমায় অস্ত্রবাজদের অবাধ বিচরণ : এদিকে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে র‌্যাব-পুলিশের অভিযানে প্রতিদিনই মিলছে আগ্নেয়াস্ত্র, ধরা পড়ছে ব্যবহারকারী সন্ত্রাসীও। কিন্তু নানা প্রক্রিয়ায় জঙ্গি গোষ্ঠী, দাগি ও পেশাদার অপরাধী রাজনৈতিক ছদ্মাবরণে আগ্নেয়াস্ত্রের ব্যবহার ও মজুদের পাঁয়তারায় লিপ্ত আছে। সন্দেহভাজন অস্ত্র ব্যবসায়ী ও অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে গোয়েন্দা নজরদারিসহ অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হচ্ছে বলেও পুলিশের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছেন। রাজধানীজুড়ে র‌্যাব-পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা থাকায় রাজধানী-ঘেঁষা শহর-জনপদ এখন দুর্ধর্ষ অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীদের নিরাপদ ঘাঁটিতে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে সাভারের আমিনবাজার, বড়দেশী, কাউন্দিয়া, ভাকুর্তা, কেরানীগঞ্জের কালীগঞ্জ বাজার, জিঞ্জিরাসহ আশপাশের মহল্লাসমূহ, টঙ্গী, আশুলিয়া, রূপগঞ্জের চনপাড়া বস্তিসহ আশপাশের এলাকা, নারায়ণগঞ্জের সাইনবোর্ড ও ফতুল্লার একটি হাউজিং এলাকা এবং মোহাম্মদপুরের বসিলা পয়েন্টগুলো দিন দিনই বিপজ্জনক হয়ে উঠেছে। সেসব স্থানে পেশাদার সন্ত্রাসীদের অবাধ বিচরণের সুযোগে ছোট ছোট সন্ত্রাসী গ্রুপ তৈরি হয়েছে, তাদের হাতে হাতে উঠে এসেছে আগ্নেয়াস্ত্র। হাত বাড়ালেই মিলছে মানুষ মারার অস্ত্রশস্ত্র। দেশি-বিদেশি, ছোট-বড় নানারকম অস্ত্রশস্ত্র কেনাবেচাও চলছে সংগোপনে। খোদ রাজধানীর বিভিন্ন পয়েন্টেও মিলছে এসব অস্ত্র। এমনকি কিস্তিতে এসব অস্ত্র বিক্রির বিশেষ সুযোগ দেওয়ায় কিশোর-তরুণদের হাতেও এসব সহজলভ্য হয়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে কিশোর গ্যাং। স্কুলপড়ুয়া এসব কিশোরকে নিয়ে সীমাহীন উৎকণ্ঠায় আছেন অভিভাবকরা। প্রতিটি এলাকাতেই নানা নামে নানা গ্রুপ গড়ে তুলেই তারা মুহুর্তে অস্ত্রবাজ সন্ত্রাসীতে পরিণত হচ্ছে। অল্পবয়সী এসব কিশোর-তরুণ হাতে অস্ত্র পেলেই ধরাকে সরা জ্ঞান করছে, যত্রতত্র তা প্রদর্শনসহ মারাত্মক সব অপরাধ সংঘটন করে চলছে। রাজধানীর টার্মিনাল ও অটোস্ট্যান্ড কেন্দ্রিক যেসব চাঁদাবাজ গ্রুপ রয়েছে তাদের হাতে হাতেও বিপুল আগ্নেয়াস্ত্র থাকার তথ্য আছে গোয়েন্দাদের কাছে।-বিডি প্রতিদিন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *