স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করে দেশের অর্ধকোটির বেশি মানুষ ঈদ যাত্রায় শামিল হলেও গত কয়েকদিনে নমুনা পরীক্ষা কহওয়ায় করোনার রোগী শনাক্তের হার কমেছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, সপ্তাহওয়ারি হিসাবে টানা সাত দিন সংক্রমণ শনাক্তের হার ৭ থেকে ৮ শতাংশের মধ্যে। অথচ ঈদের আগেও তা ৯ শতাংশের ওপরে ছিল। হিসাবে শনাক্তের হার নিম্নমুখী হলেও বাস্তবতা ভিন্ন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। সূত্র : যায়যায়দিন

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ঈদকে সামনে রেখে লাখ লাখ মানুষ যেভাবে গাদাগাদি করে মার্কেট, শপিংমল ও বিপণি বিতান ঘুরে কেনাকাটা করেছে; কর্মজীবী মানুষ গ্রাআেসা-যাওয়া করেছে- তাতে সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার কথা। নমুনা পরীক্ষা কম হওয়ায় শনাক্তের হার হয়তো কম দেখা যাচ্ছে। আগের মতো প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০ হাজার নমুনা পরীক্ষা করা হলে শনাক্তের হারও বাড়বে। ঈদের আগে-পরে মানুষ যেভাবে সব ধরনের বিধিনিষেধ উপেক্ষা করে চলাচল করছে তাতে আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই করোনা সংক্রমণের ঊর্ধ্বমুখী চিত্র দেখা যাবে বলে তারা আশঙ্কা করছেন। তাদের ভাষ্য, কোভিড মোকাবিলায় বাংলাদেশ উল্টো পথে হাঁটছে। এতে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পরিকল্পনার সঠিক বাস্তবায়ন ঘটছে না। করোনা সংক্রমণের বাস্তব চিত্র পেতে হলে দেশের সবখানেই সমানভাবে নমুনা পরীক্ষা বাড়াতে হবে।

কোভিড চিকিৎসা ও নমুনা পরীক্ষার সঙ্গে সংশ্লিষ্টরা, করোনা শনাক্তের বর্তমান পরিসংখ্যানের সঙ্গে বাস্তব চিত্রের ভিন্নতার কথা পরোক্ষভাবে স্বীকার করেছেন। তারা জানান, ঈদের কয়েকদিন পর থেকে নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা একটু একটু করে বাড়ার সঙ্গে শনাক্তের হার ঊর্ধ্বমুখী হচ্ছে। এতে বোঝা যাচ্ছে, নমুনা পরীক্ষার সংখ্যা ২৫ হাজারের ওপরে উঠলেই আক্রান্ত রোগীর হারও বাড়বে।

সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশে বরাবরের মতো ঢাকা-চট্টগ্রাম-খুলনাসহ বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়ের হাতেগোনা কয়েকটি বড় শহরে নমুনা পরীক্ষা বেশি হচ্ছে। সে তুলনায় ছোট শহর, উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলে নমুনা পরীক্ষা হচ্ছে খুবই কম। অথচ এসব এলাকা থেকেও প্রতিনিয়ত গুরুতর অসুস্থ করোনা রোগী বড় জেলা শহরের হাসপাতালগুলোতে আসছে। অর্থাৎ সেখানেও বিপুল সংখ্যক মানুষ করোনা আক্রান্ত হলেও নমুনা পরীক্ষা না হওয়ায় তারা হিসাবের বাইরে থেকে যাচ্ছেন। শুধু গুরুতর অসুস্থ হয়ে যাদের হাসপাতালে ভর্তি হতে হচ্ছে, তাদের হিসাবই স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান উঠে আসছে।

ছোট জেলা শহর, উপজেলা ও গ্রামাঞ্চলের স্থানীয় লোকজন এবং স্বাস্থ্যকর্মীদের সঙ্গে কথা বলেও ব্যাপারে সত্যতা পাওয়া গেছে। সংশ্লিষ্টরা জানান, ঈদের পর স্থানীয়দের অনেকের মধ্যে করোনার উপসর্গ দেখা দিয়েছে। বিশেষ করে সীমান্তবর্তী জেলাগুলোর বাসিন্দাদের মধ্যে করোনার উপসর্গ বেশি দেখা যাচ্ছে।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক বে-নজির আহমেদ বলেন, ‘স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিসংখ্যান হ পৃষ্ঠা ২ কলা৬

চিত্রে সংক্রমণের যে হার দেখা যাচ্ছে তা বাস্তবচিত্র নির্দেশ করছে না, এটা নানাভাবে প্রমাণ করা যায়। পরীক্ষা বাড়লে আক্রান্তের সংখ্যা বাড়ছে। তাতে বোঝা যায়, নমুনা পরীক্ষা কহওয়ায় আপাতদৃষ্টিতে শনাক্তের হার কদেখা যাচ্ছে।’

সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে নমুনা পরীক্ষা, সন্দেহভাজন রোগী শনাক্তকরণ, আইসোলেশন ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলা কোনোটিই সঠিকভাবে হচ্ছে না; তাহলে দেশে সংক্রমণ কেন কমবে- পাল্টা এমন প্রশ্ন তুলে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ বলেন, সব খুলে দেওয়া হয়েছে, কেউ কিছু মানছে না। কিছুদিনের মধ্যে সংক্রমণ আবার ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা দেখা দেওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

এদিকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বলছে, ১ ২ে৪ ঘণ্টায় ১৫ হাজার ১১৭ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ৪৫২ জনের শরীরে করোনা শনাক্ত হয়। হিসেবে ওই দিন শনাক্তের হার ছিল ৯.৬১ শতাংশ। ২ ১ে৪ হাজার ১৫৮ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৩৫৯ জন (৯.৬%), ৩ ১ে৯ হাজার ৪৩১ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৭৩৯ জন (৮.৯৫%), ৪ ২ে১ হাজার ৯৮৪ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৯১৪ জন (৮.৭১%), ৫ ২ে০ হাজার ২৮৪ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৭৪২ জন (৮.৫৯%), ৬ ২ে১ হাজার ৫৮৫ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৮২২ জন (৮.৪৪%), ৭ ১ে৭ হাজার ১৩ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৬৮২ জন (৯.৮৯%), ৮ ১ে৪ হাজার ৭০৩ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ২৮৫ জন (৮.৭৪%), ৯ ১ে৬ হাজার ৯১৫ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৩৮৬ জন (৮.১৯%), ১০ ১ে৬ হাজার ৮৪৮ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৫১৪ জন (৮.৯৯%), ১১ ১ে৪ হাজার ১৮৪ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ২৩০ জন (৮.৬৭%), ১২ ১ে৫ হাজার ২৯৬ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ১৪০ জন (৭.৪৫%), ১৩ ১ে৩ হাজার ৪৭১ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ২৯০ জন (৯.৫৮%), ১৪ ৭ে হাজার ৮৩৫ জনের পরীক্ষা করে ৮৪৮ জন (১০.৮২%), ১৫ ৩ে হাজার ৭৫৮ জনের পরীক্ষা করে ২৬১ জন (৬.৯৫%), ১৬ ৫ে হাজার ৪৩০ জনের পরীক্ষা করে ৩৭৩ জন (৬.৬৯%), ১৭ ১ে০ হাজার ৩৪৭ জনের পরীক্ষা করে ৬৯৮ জন (৬.৭৪%), ১৮ ১ে৬ হাজার ৮৫৫ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ২৭২ জন (৭.৫৫%), ১৯ ২ে০ হাজার ৫২৮ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৬০৮ জন (৭.৮৩%), ২০ ১ে৯ হাজার ৪৩৭ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৪৫৭ জন (৭.৫০%) এবং ২১ ১ে৮ হাজার ২৯৪ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ৫০৪ জন (৮.২২%), ২২ ১ে২ হাজার ২৩০ জনের পরীক্ষা করে ১ হাজার ২৮ জন (৮.৪০%) করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়।

পরিসংখ্যান চিত্র বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, পহেলা থেকে ২১ পের্যন্ত ৩ সপ্তাহে মোট ৩ লাখ ২৩ হাজার ৪৭৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে মোট ২৭ হাজার ৫৭৬ জনকে করোনা রোগী শনাক্ত করা হয়। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১৫ হাজার ৪০৩ জনের নমুনা পরীক্ষা করে ১ হাজার ৩১৩ জন রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। হিসেবে উলেস্নখিত তিন সপ্তাহে শনাক্তের গড় হার সাড়ে ৮ শতাংশের কিছু বেশি।

প্রসঙ্গে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া অঞ্চলের সাবেক উপদেষ্টা মোজাহেরুল হক যায়যায়দিনকে বলেন, ঈদে ছোটাছুটির কারণে নমুনা পরীক্ষা কহওয়াতে শনাক্তের হার স্থিতিশীল দেখা যাচ্ছে। তবে এতে স্বস্তির কোনো বিষয় নেই। তার ভাষ্য, এখনো রোগী শনাক্তের যে হার, তাতে সংক্রমণ নিয়ন্ত্রণে আনা থেকে বাংলাদেশ বেশ দূরে। টানা তিন সপ্তাহ যদি পরীক্ষার তুলনায় শনাক্তের হার ৫ শতাংশের নিচে থাকে, তাহলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে এসেছে বলে ধরা যায়। সে ক্ষেত্রে শর্ত হচ্ছে প্রতিদিন নূ্যনত২০ হাজার মানুষের নমুনা পরীক্ষা করতে হবে এবং দেশের সব জেলা থেকে নমুনা সংগ্রহের বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। হিসেবে করোনা পরিস্থিতি এখনো নিয়ন্ত্রণে আসেনি। আর অনিয়ন্ত্রিত পরিস্থিতিতে স্বাস্থ্যবিধি উপেক্ষা করা হলে করোনা সংক্রমণ ঊর্ধ্বমুখী হবে, সেটাই স্বাভাবিক।

জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নমুনা পরীক্ষার হার নিম্নমুখী হয়েছে। যার প্রভাব শনাক্তের হারের ওপর পড়েছে। এছাড়া প্রায় পৌনে এক কোটি মানুষ বিভিন্ন বিভাগীয় ও জেলা শহর থেকে ঈদে বাড়িতে ফিরলেও অধিকাংশ গ্রাও উপজেলায় নমুনা পরীক্ষার যথাযথ সুবিধা না থাকায় অনেকের শরীরে করোনার উপসর্গ দেখা দেওয়ার পরও তারা তৎক্ষণিক পরীক্ষা করাতে পারেনি। এজন্য তারা অনেকে শহরে ফেরার জন্য অপেক্ষা করেছেন। কারণে এখন ঢাকাসহ বিভিন্ন বিভাগীয় শহরে নমুনা পরীক্ষা ও শনাক্তের হার ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। তবে গ্রাযোরা আক্রান্ত হচ্ছেন, তাদের মধ্যে অনেকেই তীব্র উপসর্গ না দেখা দেওয়া পর্যন্ত নমুনা পরীক্ষা না করিয়েই তারা নানা ধরনের অ্যান্টিবায়েটিক ওষুধ খাচ্ছেন। গ্রামাঞ্চলের মানুষের প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় অনেকে এমনিতেই সেরে উঠছেন।

নমুনা পরীক্ষার ল্যাবে কর্মরত বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ এক জেলায় কমলে অন্য জেলায় বাড়ছে। এছাড়া টানা প্রায় তিন সপ্তাহে শনাক্তের হার মাত্র ১ শতাংশ কমেছে। এর মধ্যে দুই সপ্তাহ নমুনা পরীক্ষা কহয়েছে। উপসর্গ নেই এমন সন্দেহজনকদের পরীক্ষা করা হচ্ছে না। এসব কারণে আপাতদৃষ্টিতে সংক্রমণের হার হয়তো সামান্য নিচে নেএেসেছে। কিন্তু নমুনা পরীক্ষা বাড়ানো হলে এবং লোকজনের ঈদের ছোটাছুটি কমলে সংক্রমণের হার ঠিক কত তা বোঝা যাবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *