ঘরমুখো মানুষকে গ্রামে-গঞ্জে পৌঁছে দিতে এক অভিনব ‘সিটিং সার্ভিস’ চালু করেছে নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক বিভাগ। লকডাউনে গণ পরিবহন চলাচলে বিধি নিষেধ থাকলেও হাজার হাজার মানুষকে আরামদায়ক এই ‘সিটিং সার্ভিস’ এর সুবিধা দেয়া হচ্ছে।

তবে ট্রাফিক বিভাগ একা নয়, এ কাজে তাদের দিন-রাত সহায়তা করছে দূর পাল্লার বাস সার্ভিসগুলো। এসি-নন এসি মাইক্রোবাস আর প্রাইভেটকার যোগাড় করা থেকে শুরু করে যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া আদায়, সে ভাড়া থেকে ট্রাফিক বিভাগের ‘বখরা’ আলাদা করে রাখা এবং যাত্রী সমাগম কম থাকলে মাল বোঝাই ট্রাক, পিকআপ কিংবা লরি আটকে ‘চাঁদা’ আদায়েও সহায়তা করছেন এসব বাস সার্ভিস ও লাইনে নিযুক্ত লাইনম্যানরা।

গত কয়েকদিনে জেলার সাইনবোর্ড, চিটাগাং রোড এলাকায় সরেজমিনে এমন অদ্ভুত চিত্রই দেখা গেছে। খোদ ট্রাফিক পুলিশের বক্সের সামনেই এসব মাইক্রোবাস আর প্রাইভেট গাড়ীতে তোলা হচ্ছে শত শত যাত্রী। অপরদিকে গণপরিবহন চলাচল জেলার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও এসব পরিবহনে স্বাস্থ্যবিধি মানা তো দূরে থাক, পুলিশের সামনেই রীতিমত ৩৫ সিটের এক বাসে চেপেই যাতায়াত করছেন দ্বিগুণের চেয়েও বেশী যাত্রী।

ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সাইনবোর্ড এলাকা রাজধানী ঢাকা আর নারায়ণগঞ্জ লিংক রোডের সংযোগস্থল। ৩ রাস্তার মোড়েই রয়েছে সাইনবোর্ড ট্রাফিক পুলিশের বক্স বা ছাউনি। এখানে অনেক আগে থেকেই বেশ কিছু দূর পাল্লার বাস সার্ভিসের টিকিট কাউন্টার চালু রয়েছে।

আরও আছে মহাসড়কটির দু’পাশে সিএনজি চালক বেবী ট্যাক্সির স্ট্যান্ড, একটি মাইক্রো স্ট্যান্ড ও ব্যাটারি চালিত অটো রিক্সার স্ট্যান্ড, যার সবগুলোই অবৈধ। লকডাউনে গণপরিবহন বন্ধ থাকলেও আশপাশের বা দূরের জেলায় যাত্রী যাওয়া আসা বন্ধ ছিলনা কোন ক্রমেই। তবে ট্রাফিক পুলিশের কঠোর বিধি নিষেধের কারণে প্রথমে সেখানে যাত্রী উঠা নামায় সমস্যা পোহাতে হলেও সেই সমস্যা এখন আর নেই।

কারণ, পরিবহন ব্যবসায়ী ও ট্রাফিক বিভাগ এখন মিলেমিশেই ব্যবসা করে। আশ্চর্যজনক হলেও সত্য যে, এই ট্রাফিক বক্সের সামনেই রীতিমত মাইক্রোবাসের অস্থায়ী স্ট্যান্ড তৈরি করা হয়েছে। সিএনজি ও দূর পাল্লার বাসের লাইন ম্যানরা এখন সেখানে এসব মাইক্রোবাস আর প্রাইভেট কারের দায়িত্ব পালন করেন। সকাল থেকে রাত অবধি সেখানে সরেজমিনে দেখা গেছে, বাস সার্ভিসের টিকিট কাউন্টার এখানে মাইক্রো কাউন্টারের কাজ করছে।

সাইনেবোর্ড থেকে কুমিল্লা পর্যন্ত নন এসিতে প্রতি যাত্রীর ভাড়া দিন থেকে সন্ধ্যা অবধি নেয়া হচ্ছে ৪শ টাকা। একটি হাইয়েচ (মাইক্রোবাস) গাড়ীতে মোট ১৫জন যাত্রী নেয়া হয়। তবে এসি সার্ভিসে ভাড়া ৭শ থেকে ৮শ টাকা। কুমিল্লা ছাড়াও অন্যান্য জেলাতেও যাচ্ছেন যাত্রীরা।

সন্ধ্যার পর অবশ্য রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে এখানে ভাড়ার তারতম্য ঘটে। বাহনেরও তারতম্য ঘটে মাঝে মাঝে। মাইক্রো বা প্রাইভেট কারের পাশাপাশি গভীর রাতে এখান থেকে ছাড়া হয় ছোট আকারের পিকআপ ভ্যান। পিকআপ ভ্যানে যাত্রীর বসার সুবিধা নেই বলে ভাড়া জনপ্রতি ২শ, আর রাতে মাইক্রোবাসে কুমিল্লা পর্যন্ত ভাড়া ৫শ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েকজন লাইনম্যান ও বাস সার্ভিসের কর্মচারীর সাথে আলাপ করলে তারা জানান, বাস বন্ধ থাকায় এই ব্যবস্থা, তবে ট্রাফিকের বড় ‘স্যার’কে ম্যানেজ করেই সব হচ্ছে। টিআই (ট্রাফিক ইন্সপেক্টররা) ও সার্জেন্ট স্যাররা তো হুকুমের গোলাম’।

তারা জানান, আমরাই মাইক্রোবাস ও প্রাইভেট কারের সঙ্গে কন্ট্রাক্ট করি। মাঝে মাঝে নারায়ণগঞ্জ মাইক্রো স্ট্যান্ডের গাড়ীও আসে এখানে। এখান থেকে কুমিল্লাসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম ও ঢাকা-সিলেট রুটের ১৫/১৬টি জেলায় যাত্রীরা যাতায়াত করছে। যে ভাড়া নেয়া হয় তার মধ্যে যাত্রী প্রতি ট্রাফিক বিভাগের ১শ’ থেকে ২শ টাকা দিতে হয়। বাকি টাকার মধ্যে গাড়ীর ভাড়া, লাইনম্যানের রোজ (দৈনিক পারিশ্রমিক) দিয়ে বাস সার্ভিসের থাকে’।

অন্য জেলার ট্রাফিক বা পুলিশ গাড়ী আটকালে কি করেন এমন প্রশ্নের জবাবে তারা জানান, ওইসব জেলা থেকেও তো মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকারে যাত্রীরা মাঝে মাঝে আসে। সব মিলেমিশেই হয়, তবে অন্য জেলায় আটকালে সেখানেও মাঝে মাঝে টাকা দিতে হয়।

নারায়ণগঞ্জ ট্রাফিক বিভাগের চট্টগ্রাম রোডের ছাউনি বা বক্সটি অনেক আগে থেকেই সমালোচিত। জেলার সাবেক এক ট্রাফিক পরিদর্শক এই ট্রাফিক বক্সে এসি (শীতাতপ যন্ত্র) লাগিয়ে অফিস করতেন। তিনি বদলী হলেও তার যথেষ্ট প্রভাব এখনও রয়ে গেছে বলে ট্রাফিক বিভাগের অনেকেই জানিয়েছেন।

এই ট্রাফিক বক্সের আশে-পাশে গত ২ যুগ ধরেই রয়েছে দূর পাল্লার কমপক্ষে ২ ডজন বাস কাউন্টার। এখান থেকেও একই কায়দায় দূর-দূরান্তে যাত্রী সার্ভিস দেয়া হচ্ছে, তবে সেটি রাতে।

এখানে নিযুক্ত লাইনম্যানরা জানান, দিনের বেলায় এখানে ঢাকামুখি ও ঢাকা থেকে আসা হাজার হাজার যানবাহন সামাল দিতেই হিমশিম খেতে হয় তাদের। তাই রাতের বেলায় যাত্রী উঠানো হয়।

তারা আরও জানান, মালবাহী বা পণ্যবাহী ট্রাক, লরি চলাচলে বিধিনিষেধ না থাকলেও ট্রাফিক পুলিশ রাতে এসব আটকায়, কাগজপত্র চেক করে। বেশিরভাগেরই কাগজপত্র ঠিক থাকে না। তখন কিছু দিয়ে নিয়ে এগুলো ছেড়ে দেয়, আমরাও এই কাজে সহায়তা করি।

এ ব্যাপারে জেলা ট্রাফিকের সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার সালেহ উদ্দিন আহমেদ বিষয়টি জানেন না বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেন, পুলিশ বক্সের সামনে যাত্রী উঠা-নামা বা এই সময়ে যাত্রী অন্য জেলায় পরিবহনের কোনো সুযোগ নেই এবং করলে সেটা অবশ্যই আইনত দণ্ডনীয়। এমনটি হয়ে থাকলে আমি কঠোর ব্যবস্থা নেব। – যুগান্তর

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *