করোনা-পূর্ব পরিস্থিতিতে ভারতে মোট অক্সিজেন সরবরাহের ১৫ শতাংশ ব্যবহার হতো স্বাস্থ্য খাতে। বাকি ৮৫ শতাংশের ব্যবহারকারী ছিল শিল্প খাত। কিন্তু কভিডের দ্বিতীয় প্রবাহের ধাক্কায় এখন এ চিত্র একেবারে পাল্টে গেছে। মোট অক্সিজেন সরবরাহের ৯০ শতাংশই ব্যবহার হচ্ছে দেশটির স্বাস্থ্য খাতে। আগের বছরের তুলনায় এ খাতে তিন গুণ বেশি অক্সিজেন ব্যবহার হচ্ছে।
চাহিদার এমন উল্লম্ফনে অক্সিজেন সংকটে হিমশিম খেতে হচ্ছে ভারতকে। কভিডের সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে ভারতে অক্সিজেনের চাহিদা এত ব্যাপক হারে বেড়ে গেছে, যার ফলে তা সময়মতো সরবরাহও করা যাচ্ছে না। অক্সিজেনের অভাবে হাসপাতালগুলোতে মৃত্যু হচ্ছে কভিড-১৯ আক্রান্ত রোগীদের। ২৩ এপ্রিল ভারতের রাজধানী দিল্লির একটি হাসপাতালে অক্সিজেনের অভাবেই ২০ জন কভিড রোগীর মৃত্যু হয়েছে।
বাংলাদেশের করোনা সংক্রমণ পরিস্থিতিও বর্তমানে বেশ নাজুক। গতকালই মৃতের সংখ্যা ১১ হাজার ছাড়িয়েছে। সর্বশেষ ১০ দিনে এক হাজার রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। এখন পর্যন্ত ভাইরাসটিতে আক্রান্ত হিসেবে শনাক্তের সংখ্যা সাড়ে সাত লাখের কাছাকাছি পৌঁছেছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার ঘোষিত কঠোর নিষেধাজ্ঞা চলছে এখন দেশে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংক্রমণ বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশেও ভারতের মতো অক্সিজেন সংকট হতে পারে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, গত প্রায় এক মাসে অক্সিজেনের চাহিদা বেড়েছে স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় দ্বিগুণ।
জানা গেছে, স্বাভাবিক সময়ে বাংলাদেশে মেডিকেল অক্সিজেনের দৈনিক চাহিদা ১০০-১২০ টন। বর্তমানে এ চাহিদা বেড়ে হয়েছে ১৫০-১৮০ টন। স্বাভাবিক সময়ে প্রতিদিনের ১০০ টন বিবেচনায় বর্তমানে চাহিদা বেড়েছে ৮০ শতাংশ। চাহিদা বৃদ্ধির এ উল্লম্ফনের পরিপ্রেক্ষিতে অক্সিজেন উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, অক্সিজেন সংকট এখনো দেখা দেয়নি। তবে চাহিদার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সরবরাহ ঠিক রাখতে হিমশিম খেতে হচ্ছে উৎপাদকদের। সংক্রমণ বাড়তে থাকলে ভারতের মতো অক্সিজেন সংকট হতে পারে বাংলাদেশেও।
এদিকে বাংলাদেশে অক্সিজেনের তীব্র সংকট দেখা দিতে পারে, এমন শঙ্কা দেখছেন না স্বাস্থ্য খাতসংশ্লিষ্টরা। তাদের দাবি, ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি বন্ধ রয়েছে। এটি বিবেচনায় নিয়ে অন্যান্য দেশের উৎস থেকে অক্সিজেন আমদানির কথা ভাবতে হবে। এজন্য অর্থের সংস্থানও করতে হবে। মোটাদাগে আপত্কালীন সময়ের জন্য প্রস্তুত হতে হবে। আগামী বেশ কয়েক দিন হয়তো সংক্রমণের মাত্রা কিছুটা কমবে, তাতে সময় পাওয়া যাবে প্রস্তুতি নেয়ার।
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল বাশার মোহাম্মদ খুরশীদ আলম বলেন, কিছুটা ঘাটতি থাকায় দুটি প্রতিষ্ঠান ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করত। এখন তা বন্ধ রয়েছে। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছে। এর চেয়ে বেশি প্রয়োজন হলে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন উৎপাদন বন্ধ করে প্রতিষ্ঠানগুলোকে মেডিকেল অক্সিজেন উৎপাদন করতে বলা হবে।
সূত্র অনুযায়ী, স্বাভাবিক সময়ে মেডিকেল ও শিল্প মিলিয়ে দেশে অক্সিজেনের চাহিদা প্রতিদিন প্রায় ২২০-২৫০ টন। বাংলাদেশে মোট অক্সিজেন চাহিদার ৭৫ শতাংশই সরবরাহ করে লিন্ডে বাংলাদেশ। এর বাইরে অক্সিজেন উৎপাদনকারী উল্লেখযোগ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে অন্যতম স্পেকট্রা অক্সিজেন লিমিটেড ও ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেড।
ইসলাম অক্সিজেনের উৎপাদন সক্ষমতা প্রতিদিন ৪০ টন। প্রতিষ্ঠানটি সূত্রে জানা গেছে, ক্রমবর্ধমান চাহিদা বিবেচনায় উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এজন্য ব্যাংক অর্থায়নের চেষ্টা চলছে। কভিডের আগে অক্সিজেনের চাহিদা যা ছিল, তা দ্বিগুণ হয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন শিল্পে কোনো অক্সিজেন সরবরাহ করছে না। উৎপাদনের সবটুকুই দেয়া হচ্ছে হাসপাতালগুলোতে।
জানতে চাইলে ইসলাম অক্সিজেন লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মুস্তাইন বিল্লাহ বলেন, সংক্রমণ যদি আরো বাড়ে, তাহলে নিঃসন্দেহে আমরা বিপদে পড়ব। সংকটময় পরিস্থিতিতে সরবরাহ দিয়ে শেষ করা যাবে না, মানুষ মারা যাবে। এখানে আনুষঙ্গিক সমস্যাও আছে। নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত না হওয়ায় উৎপাদন সক্ষমতার পুরোটা কাজে লাগাতে পারছি না। আপত্কালীন পরিস্থিতিতে কী হবে বোঝা যাচ্ছে না।
গ্যাসীয় ও তরল—দুই আকারে অক্সিজেন সরবরাহ করছে লিন্ডে বাংলাদেশ। সরকারি হাসপাতালগুলোর চাহিদার বেশির ভাগই সরবরাহ করে অক্সিজেন সরবরাহকারী অন্যতম এ প্রতিষ্ঠান। এছাড়া বড় কিছু বেসরকারি হাসপাতালেও অক্সিজেন সরবরাহ করা হয়। মেডিকেল অক্সিজেনের চাহিদা বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে গত ছয় সপ্তাহে দ্বিগুণেরও বেশি অক্সিজেন সরবরাহ করেছে লিন্ডে।
উৎপাদনের পুরোটাই এখন শুধু মেডিকেলে সরবরাহ করতে হচ্ছে উল্লেখ করে লিন্ডে বাংলাদেশের মুখপাত্র সাইকা মাজেদ বলেন, শিল্পে অক্সিজেন সরবরাহ করা হচ্ছে না। এক বছর ধরে ভারত থেকে অক্সিজেন আমদানি করা হয়েছে। কিন্তু গত দু-তিন দিন হলো তা বন্ধ রয়েছে। এখন পর্যন্ত চাহিদা ও সরবরাহ ঠিক আছে। কিন্তু পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে অবস্থা সুবিধাজনক হবে না। এখন সরকারি পর্যায়ে উদ্যোগ নিয়ে ব্যক্তি খাতের প্রতিষ্ঠানের সহযোগিতায় অক্সিজেন সরবরাহ ঠিক রাখার বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছে।
এদিকে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়ার আগেই পরিকল্পনা হাতে নিয়ে কাজ করা দরকার বলে মনে করেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (রোগ নিয়ন্ত্রণ) ডা. বে-নজির আহমেদ। তিনি বলেন, ‘ভারতের মতো পরিস্থিতি যেন সৃষ্টি না হয়, এজন্য আমাদের পরিকল্পনামাফিক কিছু কাজ করতে হবে। প্রথমে দেখতে হবে দৈনিক রোগীর সংখ্যা কত, তাদের চাহিদা কত, কত সরবরাহ আছে এবং কী পরিমাণ ঘাটতি রয়েছে। এরপর একটি সমীক্ষা করতে হবে যে আগামী সাতদিন, ১৫ দিন বা এক মাসে কত রোগী হতে পারে এবং কত চাহিদা হবে। এটা একটা ধারণা। এরপর সরবরাহ নিশ্চিত করতে যারা অক্সিজেন উৎপাদন ও সরবরাহ করে, সেসব প্রতিষ্ঠানকে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অক্সিজেন থেকে মেডিকেল অক্সিজেন সরবরাহ করতে বলতে হবে। এখানেও তাদের কত ক্ষতি হবে এবং কতটুকু চাহিদা পূরণ হবে, তা নির্ণয় করতে হবে।
দেশে সংক্রমণ শনাক্তের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে সংকটাপন্ন রোগীর সংখ্যা। বাংলাদেশে অক্সিজেনের চাহিদা ও সরবরাহ সংকট এখন তীব্র না হলেও কভিড চিকিৎসার অপরিহার্য মেডিকেল ডিভাইসের সংকট রয়েছে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া তথ্য বলছে, চাহিদার তুলনায় সরকারের কাছে মজুদ রয়েছে মাত্র ৩৯ শতাংশ যন্ত্রপাতি। অপর্যাপ্ত মজুদ থাকা যন্ত্র ও উপকরণগুলোর মধ্যে আছে হাই ফ্লো ন্যাজাল ক্যানুলা, অক্সিজেন কনসেনট্রেটর, মনিটরসহ আইসিইউ বেড, ভেন্টিলেটর ও অক্সিজেন সিলিন্ডার।