বিএনপির সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ ইস্যুতে স্থায়ী কমিটির প্রভাবশালী সদস্য মির্জা আব্বাসের বক্তব্য ব্যাপক আলোড়ন তুলেছে দলের ভেতর-বাইরে। নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে। কেন, কী কারণে এবং কাকে উদ্দেশ করে মির্জা আব্বাস এমন বক্তব্য দিয়েছেন- তা নিয়ে চলছে ব্যাপক আলোচনা।

এ ঘটনায় বিএনপির হাইকমান্ডও বিস্মিত ও ক্ষুব্ধ আব্বাসের ওপর। দলের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণ ফোরামের সদস্যের এ বক্তব্য সরকারকে ‘দায়মুক্ত’ হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছে বলে মনে করছেন দলটির নেতাকর্মীরা। তাদের দাবি, মির্জা আব্বাস নিজের এবং দলের বড় ধরনের ক্ষতি করে ফেললেন, যা সহজে আর পুষিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে না।

ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হওয়ার ৯ বছর পূর্তির দিন গত শনিবার এক ভার্চুয়াল আলোচনা সভায় মির্জা আব্বাস বলেছিলেন, ইলিয়াসকে আওয়ামী লীগ সরকার গুম করেনি। গুম হওয়ার আগের রাতে দলীয় অফিসে কোনো এক ব্যক্তির সঙ্গে তার মারাত্মক বাগ্‌বিতণ্ডা হয়। এ ঘটনার পেছনে দলেরই অভ্যন্তরীণ লুটপাটকারী, বদমায়েশগুলো আছে। যদিও তার ওই বক্তব্যের পরদিনই গতকাল রোববার সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস দাবি করেছেন, ইলিয়াস আলী ইস্যুতে তিনি যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা সরকারকে কটাক্ষ করে বলা। তার মূল বক্তব্য ছিল, ইলিয়াস গুমের বিষয়ে সরকারকেই জবাব দিতে হবে। তার এ বক্তব্যকে গণমাধ্যমে বিকৃত করা হয়েছে।

মির্জা আব্বাসের বক্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সমকালকে বলেন, মির্জা আব্বাস সংবাদ সম্মেলন করে তার বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন। এর বাইরে তার আর কিছু বলার নেই।

বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এ ঘটনায় দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান চরম ক্ষুব্ধ হয়েছেন মির্জা আব্বাসের ওপর। মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে উদ্দেশ করে বক্তব্য দেওয়ায় তিনিও চরম বিব্রতবোধ করছেন।

বিএনপির বেশ কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলোচনা করে জানা গেছে, মির্জা আব্বাসের এ বক্তব্যের পর বিএনপিতে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে। কারণ, এত দিন বিএনপি ইলিয়াস আলী নিখোঁজের জন্য ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে দায়ী করে আসছিল। কিন্তু আব্বাসের এ বক্তব্য তাদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। বিএনপির ক্ষুব্ধ নেতারা মনে করছেন, মির্জা আব্বাসের এ বক্তব্যের মাধ্যমে সরকারের হাতে নতুন হাতিয়ার তুলে দেওয়া হয়েছে এবং ইচ্ছা করেই এ অস্ত্র তুলে দেওয়া হলো। এমন প্রেক্ষাপটে দলের সর্বোচ্চ হাইকমান্ড মির্জা আব্বাসকে সংবাদ সম্মেলন করে তার বক্তব্য স্পষ্ট করার নির্দেশনা দেন। নির্দেশিত হয়ে গতকাল রোববার এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস দাবি করেছেন, তার বক্তব্যকে বিকৃতি করা হয়েছে, খণ্ডিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে।

বিএনপির নেতাকর্মীরা দু’দিন ধরে মির্জা আব্বাসের এ বক্তব্যের কারণ খুঁজে ফিরছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন উপায়ে ৯ বছর পর হঠাৎ করে তার এমন বক্তব্য নিয়ে নানা কৌতূহল প্রকাশ করছেন। যদিও মির্জা আব্বাস প্রভাবশালী সিনিয়র নেতা হওয়ার কারণে নেতারা প্রকাশ্যে এ নিয়ে কোনো বক্তব্যই দিচ্ছেন না। তবে সবারই কৌতূহল, গুমের আগের দিন ইলিয়াস আলী কার সঙ্গে বাগ্‌বিতণ্ডা করেছিলেন, দলীয় নেতাদের মধ্যে তেমন কেউ কি সত্যিই আছেন, যিনি গুমের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে পারেন।

বিএনপির কোনো কোনো নেতার দাবি, ইলিয়াস আলী গুমের আগের দিন রাতে বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয়ের একজন ‘প্রভাবশালী কর্মকর্তা’র সঙ্গে প্রচণ্ড ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়েন। ইলিয়াস সেদিন তাকে মারতে উদ্যত হন। ওই কর্মকর্তাকে অনেকেই ‘একটি রাষ্ট্রের এজেন্ট’ হিসেবে ইঙ্গিত করে থাকেন। হয়তো মির্জা আব্বাস গুলশান কার্যালয়ের ওই কর্মকর্তাকেই ইলিয়াস ইস্যুতে জড়িত করেছেন।

তবে সবকিছুর পরও দলের গুরুত্বপূর্ণ একজন নেতা ইলিয়াস আলীর গুমের বিষয়ে সরকারকে দায়ী না করে মির্জা আব্বাস দলের রাজনীতির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন বলে অনেক নেতা মনে করছেন। তারা দাবি করছেন, মির্জা আব্বাসের এ বক্তব্যে সরকারকে ‘ক্লিনচিট’ দেওয়া হয়েছে। যে পরিপ্রেক্ষিতে এবং ইলিয়াস আলীর সন্ধানের দাবিতে বিএনপি দীর্ঘদিন ধরে আন্দোলন করেছে, তাকেই তিনি প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।

বিএনপির একজন এমপি নাম প্রকাশ না করার শর্তে সমকালকে বলেন, এ বক্তব্য দিয়ে জাতীয় সংসদ কিংবা বিভিন্ন প্ল্যাটফর্মে বিএনপির কার্যক্রমকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়েছে। তাদের বক্তব্য দেওয়ার পরিসরকে সীমিত করে ফেলা হয়েছে। এ বক্তব্যের ফলে বিএনপি নতুন এক সমস্যার মধ্যে উপনীত হয়েছে। ক্ষুব্ধ নেতারা দাবি করেন, মির্জা আব্বাস নিজের বলয়ের বাইরে দলের স্বার্থে কোনো চিন্তা করেন না। ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সদস্য সচিব হিসেবে দলের যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেলকে তিনি একদিনও মহানগর অফিসে বসতে দেননি। দলের প্রতিটি অঙ্গসংগঠনের কেন্দ্রীয় ও ঢাকা মহানগরের সভাপতি বা সাধারণ সম্পাদকের পদে তিনি তার বলয়ের একজনকে অযোগ্য হলেও স্থান করে দিতে হাইকমান্ডকে বাধ্য করেন। যেখানে সুযোগ পান, সেখানে নিজের গ্রুপের নেতাদের পদায়ন করে বলয় শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। ঢাকা মহানগরের সভাপতি থাকা অবস্থায় মরহুম সাদেক হোসেন খোকার বিরুদ্ধে তিনি নানা বিষোদ্গার করেছেন। অথচ তাকে আহ্বায়ক করার পর নগরীতে একটি মিছিলও করেননি।

অবশ্য মির্জা আব্বাসের পক্ষে কয়েকজন নেতার যুক্তি, প্রত্যেক নাগরিকের নিরাপত্তা দেওয়া রাষ্ট্র ও সরকারের দায়িত্ব। সেই নিরাপত্তায় যে-ই বিঘ্ন ঘটাবে, তাকে চিহ্নিত করে বিচারের আওতায় আনা সরকারের কর্তব্য। বিএনপির নেতারা এই অপরাধের সঙ্গে জড়িত থাকলে এতদিন কেন কাউকে আইনের আওতায় আনা হয়নি। আবার একজন নাগরিক হিসেবে ইলিয়াস আলীর নিরাপত্তা কেন দেওয়া হয়নি কিংবা তাকে কেন ফিরিয়ে দেওয়া হয়নি। ইলিয়াস আলীকে ফিরে পাওয়ার জন্য তার স্ত্রী তার পরিবারসহ বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করেছেন। তার কাছে আকুতি জানিয়েছিলেন। সরকার যদি স্বচ্ছ অবস্থানেই থাকে, তাহলে ইলিয়াস আলীকে কেন ফিরে পাওয়ার ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।

প্রসঙ্গত, ২০১২ সালের ১৭ এপ্রিল ঢাকার বনানী থেকে গাড়িচালক আনসার আলীসহ নিখোঁজ হন এম ইলিয়াস আলী। বিএনপি অভিযোগ করে আসছে তাকে সরকারই ‘গুম’ করেছে।

‘আমার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে’: দলের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক এম ইলিয়াস আলীকে সরকার গুম করেনি বলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস যে বক্তব্য দিয়েছেন, সেটা সরকারকে কটাক্ষ করে বলা হয়েছে। গতকাল রোববার বিকেলে রাজধানীর শাহজাহানপুরে নিজের বাসায় এক সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস এ দাবি করেছেন।

সংবাদ সম্মেলনে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য হয়ে কেন ওই কথা বলব? সরকার জড়িত নয়- এ বক্তব্যটি আমি কটাক্ষ করে বলেছি। এর অর্থ, সরকারই বলুক ইলিয়াস আলী কোথায় আছে। সরকারকেই এর জবাব দিতে হবে। এই সরকারের সময়ে একজন তরতাজা সত্যভাষী ইলিয়াস গুম হয়ে যাবে? অথচ সরকার তা জানে না? তাহলে কে করল গুম? আমি এটা বলতে চেয়েছি।’ গণমাধ্যমে তার বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে বলেও দাবি করেন তিনি।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্য বলেন, ইলিয়াস আলী গুমের জন্য বিএনপির কিছু নেতা দায়ী- আমি কি এই কথা বলেছি? কেউ কি তা প্রমাণ করতে পারবে? বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য হয়ে আমার পক্ষে কি এমন বক্তব্য দেওয়া সম্ভব? নিজের মাথায় নিজেই বোমা ফুটানো- এটা তো সম্ভব না। আমি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এখানেও আমার কথা বিকৃত করা হয়েছে।

মির্জা আব্বাস বলেন, আমি পরিস্কার করে একটা কথা বলতে চাই, আমার সহজসরল মনের উক্তিগুলোকে বিকৃত করে যারা কেটে-ছিঁড়ে, কাটপিস করে ইচ্ছামতো লাগিয়ে দিয়েছেন, তারা কী কারণে কী করেছেন, তা আমি জানি না। সকালে (রোববার) ইলিয়াস আলীর বাসায় একদল সাংবাদিক গেছেন। তার স্ত্রীকে গিয়ে রীতিমতো চার্জ করেছেন, বিভিন্ন প্রশ্ন করে হেনস্তা করার অপচেষ্টা চালানো হয়েছে। এটাই বা কেন? কী এমন ঘটনা ঘটল যে, তা নিয়ে এত মাথা ঘামাতে হবে?

মির্জা আব্বাস বলেন, আবারও বলছি, আমার শনিবারের বক্তব্যে সামনের অংশ, পেছনের অংশ বাদ দিয়ে মাঝখান থেকে যার যেখানে যতটুকু প্রয়োজন নিয়ে মনের মাধুরী দিয়ে যেসব কথা লিখেছেন, এর সঙ্গে আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই। আমার দল এবং আমি এর কোনো দায়িত্ব বহন করি না। যারা বলছেন, যারা লিখেছেন এর দায়িত্ব তাদের। আমি যা বলেছি আমার সংগঠনের ভালোর জন্য বলেছি।

সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতা ড. আসাদুজ্জামান রিপন, খায়রুল কবির খোকন, ফজলুল হক মিলন, কামরুজ্জামান রতন, অ্যাডভোকেট আবদুস সালাম আজাদ প্রমুখ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *