দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নদী কীর্তনখোলার পানি এতদিন দৈনন্দিন সব কাজে স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করেছে আশপাশের মানুষ। সুপেয় বা স্বাদু পানির যে বৈশিষ্ট্য তার সবই ছিল এ পানিতে। কিন্তু চলতি বছরের মার্চ থেকে হঠাৎ করেই বদলে যেতে থাকে কীর্তনখোলার পানি। এতে এখন লবণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়িয়েছে গ্রহণযোগ্য মাত্রার চেয়ে বেশি।
সাধারণত নদীর পানির ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি বা তড়িৎ পরিবাহিতা ১২০০-এর নিচে থাকলেই সেই পানিকে স্বাদু পানি বলা হয়। কয়েক দশক ধরে কীর্তনখোলা নদীর পানির মান এটির নিচেই ছিল। তবে গত মার্চ থেকে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য হারাতে শুরু করে কীর্তনখোলা। বর্তমানে এর পানির তড়িৎ পরিবাহিতা ১৩৬০-১৩৬২ পর্যন্ত উঠে গেছে। নদীতে অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে লবণাক্ততা।
নিয়মিতভাবে নদীর পানির মান পরীক্ষা করে বরিশাল বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর। গত ৭ ফেব্রুয়ারি এ নদীর ছয়টি স্থান থেকে পানি সংগ্রহ করা হয়। সে সময় পানিতে ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটির পরিমাণ সীমার মধ্যেই ছিল। কিন্তু ঠিক এক মাস পর গত ৭ মার্চ পানি পরীক্ষা করে দেখা যায়, নদীবন্দর-সংলগ্ন তীরের পানিতে ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটি ১৩৬০, মাঝনদীতে যা ১৩৬২।
পরিবেশ অধিদপ্তরের বরিশাল বিভাগীয় ভারপ্রাপ্ত পরিচালক কামরুজ্জামান সরকার বণিক বার্তাকে বলেন, প্রতি মাসেই বরিশাল বিভাগের ১৫টি নদীর পানি পরীক্ষা করা হয়। এটি তাদের নিয়মিত কার্যক্রম। মার্চে এ কার্যক্রম চলার সময় কীর্তনখোলার পানিতে ইলেকট্রিক্যাল কন্ডাক্টিভিটির এ অস্বাভাবিক হার দেখা যায়।
কী কারণে এটি হতে পারে তা জানতে চাইলে এ কর্মকর্তা বলেন, নদীর কোনো স্থানে স্বাভাবিক প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হলে এ সমস্যা হতে পারে। বিষয়টি কর্তৃপক্ষকে জানানো হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে।
নদীর পানির হঠাৎ করে লবণাক্ততার বিষয়টি প্রভাব ফেলেছে নদীর পার্শ্ববর্তী এলাকার মানুষের ওপর। আগে দৈনন্দিন কাজের জন্য নদীর পানি স্বাভাবিকভাবে ব্যবহার করলেও এখন লবণাক্ততার কারণে সেটি সম্ভব হচ্ছে না। ফলে রীতিমতো বিপদে পড়ে গেছে তারা। নদীতীরবর্তী এলাকার কয়েকজন বাসিন্দা জানান, নদীর পানির ওপর ভিত্তি করেই তাদের জীবন চলে। অথচ কিছুদিন ধরে নদীতে গোসলও করা যাচ্ছে না। ত্রিশ গোডাউন এলাকার কয়েকজন দোকানি বলেন, আগে তারা নদীর পানি দিয়েই চা তৈরি করতেন। কিন্তু এখন আর নদীর পানি ব্যবহার করা যাচ্ছে না। কারণ চায়ের স্বাদ লবণাক্ত হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জলবায়ু পরিবর্তন ও সঠিক সময়ে বৃষ্টি না হওয়ার কারণে নদীর মিঠা পানি লবণাক্ত হয়ে উঠছে। এর প্রভাবে নদী মাছশূন্য হতে পারে, পাশাপাশি পানি ব্যবহারকারীরাও ভুগতে পারে নানা অসুখে।
কীর্তনখোলার এ লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়াকে উদ্বেগজনক বলে উল্লেখ করেছে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপকূলবিদ্যা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক। তিনি বণিক বার্তাকে বলেন, লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার মূল কারণ জলবায়ুর পরিবর্তন। উজান থেকে পর্যাপ্ত পানি না এলে নদীর পানির উচ্চতা কমে যায়। পাশাপাশি সমুদ্রের পানি নদীতে ঢুকে পড়লেও লবণাক্ততা বাড়ে। এ বছর মৌসুমে স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত হয়নি। এটি কীর্তনখোলার লবণাক্ততা বেড়ে যাওয়ার কারণ হতে পারে। এ লবণাক্ততা ইলিশ উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে পারে। তাছাড়া এ পানি পান করলে মানুষের কিডনিজনিত রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। নদীতে বাস করা অন্যান্য প্রাণীর জন্যও এটি বিপজ্জনক হতে পারে।
তবে কতদিন এ লবণাক্ততা থাকবে বা এর স্থায়িত্ব বোঝার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করার কথা বললেন এ বিশেষজ্ঞ।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন ও বাংলাদেশ নদী বাঁচাও আন্দোলনের বরিশাল বিভাগীয় সমন্বয়কারী রফিকুল আলম জানান, ২০১০ সাল থেকে পরবর্তী দুই বছর যে সার্ভে করা হয়েছিল তাতে দেখা যায়, শুষ্ক মৌসুমে তেঁতুলিয়া নদী পর্যন্ত সাগরের পানি চলে আসে। তখন পরিবেশ অধিদপ্তরকে বিষয়টি জানানো হয়েছিল। এখন থেকে ১০ বছর আগেও উজান থেকে পানি আসত দেড়-দুই লাখ কিউসেক মিটার পার সেকেন্ড। এখন সেটা কমে গেছে। উজানের পানি কমতে থাকলে সাগরের পানির চাপ বাড়তে থাকে। ফলে লবণাক্ততাও বাড়ে। সে কারণে উজানের পানিপ্রবাহ বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিতে বলেন তিনি।
কীর্তনখোলার তীরে বরিশাল শহর ও দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম নৌবন্দর অবস্থিত। এটি মূলত আড়িয়াল খাঁ নদের একটি শাখা। আড়িয়াল খাঁর উত্পত্তি পদ্মা থেকে। আড়িয়াল খাঁর একটি শাখা শায়েস্তাবাদের কাছে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে ভোলার শাহবাজপুরে মেঘনা নদীর সঙ্গে মিলিত হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। অন্য শাখাটি বরিশাল শহরকে পশ্চিম তীরে রেখে দক্ষিণ-দক্ষিণপশ্চিমে প্রবাহিত হয়ে নলছিটি উপজেলা পর্যন্ত কীর্তনখোলা নামে পরিচিত এবং পরবর্তী প্রবাহ বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন নামে পরিচিত হয়ে সর্বশেষ হরিণঘাটা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। শায়েস্তাবাদ থেকে নলছিটি পর্যন্ত নদীটির দৈর্ঘ্য প্রায় ২১ কিলোমিটার ও প্রস্থ প্রায় আধা কিলোমিটার।