রাজধানীর ঢাকা উদ্যান পাবলিক হাইস্কুলে অধ্যয়নরত শিক্ষার্থীদের বড় অংশই নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তান। পড়ালেখার নিয়মিত খরচ জোগাতে যাদের অভিভাবকদের এমনিতেই নাভিশ্বাস অবস্থা। তার ওপর চলতি বছর এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নিতে জনপ্রতি ফি ধরা হয়েছে ১০ হাজার টাকা। অথচ সরকার নির্ধারিত ফি এক হাজার ৮৫০ টাকা থেকে এক হাজার ৯৭০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসাবে চলতি বছর বিদ্যালয়টির ৬৫ জন এসএসসি পরীক্ষার্থীর কাছ থেকে অতিরিক্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করছে কর্র্তৃপক্ষ।
একই অবস্থা ঢাকা উদ্যান এলাকায় অবস্থিত ১০-১২টি উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের। ঢাকা উদ্যান ল্যাবরেটরি হাইস্কুল, তুরাগ ন্যাশনাল হাইস্কুল ও ম্যানচেস্টার হাইস্কুলসহ বেশ কয়েকটি বিদ্যালয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব বিদ্যালয়ে ৭-১২ হাজার টাকা পর্যন্ত এসএসসি পরীক্ষার ফি নির্ধারণ করা হয়েছে। সরকারি হিসাবে ১ এপ্রিল থেকে এই কার্যক্রম শুরুর কথা থাকলেও শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে ইতিমধ্যে টাকা আদায় শুরু করেছে অনেক প্রতিষ্ঠান। বিষয়টি নিয়ে দরিদ্র অভিভাবকদের মধ্যে দেখা দিয়েছে উদ্বেগ। অভিযোগ উঠেছে, করোনাকালে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের বেঁধে দেওয়া কোনো নিয়মেরই ধার ধারছে না এসব বিদ্যালয়। করোনায় সারা দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখা হলেও এখানে প্রকাশ্যে ক্লাস ও কোচিং চলছে। আর শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে আদায় করা হচ্ছে মাসিক বেতন।
কয়েকজন অভিভাবকের অভিযোগ পাওয়ার পর গতকাল শনিবার দুপুরে এই প্রতিবেদক মোহাম্মদপুরের ঢাকা উদ্যান পাবলিক হাইস্কুলে যান। কথা হয়, বিদ্যালয়ের হিসাবরক্ষক আব্দুল্লাহ আল মামুনের সঙ্গে। পরীক্ষার ফি কত জানতে চাইলে পাল্টা এই প্রতিবেদকের পরিচয় জানতে চান তিনি। শিক্ষার্থীর অভিভাবক পরিচয় দিলে জানান, ১০ হাজার টাকা ফি। পরে সাংবাদিক পরিচয় দিলে মামুন বলেন, ‘আমরা তো কম নিতাছি, এখানকার অন্য স্কুলগুলাতে খোঁজ নেন, তারা ১২-১৪ হাজার টাকাও নিতাছে।’ এ সময় বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক আবুল বাশার হাওলাদারের মোবাইল ফোনে কল দিয়ে মামুন বলেন, ‘স্যার সাংবাদিক আইছে, পরীক্ষার ফি বেশি নিতাছি এটা ধরছে। আপনি ম্যানেজ করেন।’ এরপর মোবাইলের অপরপ্রান্ত থেকে আবুল বাশার হাওলাদার এই প্রতিবেদককে বলেন, ‘বলেন আপনার কী খেদমত করতে পারি?’ খেদমত করতে হবে না জানিয়ে অতিরিক্ত ফি কেন আদায় করা হচ্ছে তা জানতে চান এই প্রতিবেদক। আবুল বাশার হাওলাদার তখন বলেন, ‘এসব পত্রিকায় লিখে কিছু হয় না। আমি নিজে আট-দশটি পত্রিকার সম্পাদক। আমরাও অন্যদের খেদমত নিই।’ এক পর্যায়ে উত্তেজিত হয়ে তিনি বলেন, ‘আপনার কী করার ক্ষমতা আছে করে দেখান। আমরা যা নিচ্ছি সেটাই নেব।’
জানা যায়, ঢাকা উদ্যান এলাকার প্রেসিডেন্সি হাইস্কুল ও ঢাকা উদ্যান পাবলিক হাইস্কুল এই দুটি বিদ্যালয়ের সরকারি অনুমোদন আছে। তবে পাবলিক হাইস্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদানের অনুমোদন নেই। বাকি বিদ্যালয়গুলো মোটের ওপর অনুমোদনহীন। ফলে তারা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোনো নির্দেশনা মান্য করে না। পরীক্ষার ফি ও মাসিক ফিসহ অন্যান্য ফি আদায় করা হয় ইচ্ছেমাফিক। একমাত্র প্রেসিডেন্সি হাইস্কুলে দশম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষাদানের অনুমোদন থাকায় অন্য বিদ্যালয়গুলো প্রেসিডেন্সি হাইস্কুলের নিবন্ধনে এসএসসি পরীক্ষায় অংশ নেয়।
এ প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্সি হাইস্কুলের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক রিজওয়ানা খাতুন বলেন, ‘রেজিস্ট্রেশন ফি বাবদ দুই বছরে আমরা একজন শিক্ষার্থীর কাছ থেকে ৩ হাজার টাকা নিই। কিন্তু তারা আদায় করে ১০-১২ টাকা পর্যন্ত। সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক ফি আদায় শুরুর কথা ১ তারিখ থেকে। অথচ অনেকে কয়েকদিন আগ থেকে শুরু করেছে। এসব বিদ্যালয়ে অনিয়মের শেষ নেই। তারা ক্লাস পর্যন্ত করাচ্ছে। মাসিক ফিও আদায় করছে।’
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ঢাকা উদ্যান এলাকায় নিম্ন আয়ের মানুষদের বসবাস। ফলে এসব বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের বড় অংশই দিনমজুর পরিবারের সন্তান। বেশ কয়েকজন অভিভাবক জানান, করোনার শুরুতে প্রথম কয়েক মাস মাসিক বেতন নেওয়া বন্ধ রাখলেও পরে বিদ্যালয় কর্র্তৃপক্ষ চাপ দেওয়া শুরু করে। বিদ্যালয়গুলোতে মাসিক বেতন ৩০০ টাকা থেকে শুরু করে ১৫০০ টাকা পর্যন্ত। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা অবস্থায় মাসিক বেতন আদায় না করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয় নির্দেশ দেয়। তবে সেটি না মেনে জিম্মি করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টাকা আদায় করা হচ্ছে।
ঢাকা উদ্যান ল্যাবরেটরি হাইস্কুলের এক এসএসসি পরীক্ষার্থী নাম প্রকাশ না করে বলেন, ‘অনেক কষ্ট করে পড়ালেখা করছি। বাপ-মা টাকা দিতে পারে না। স্কুলের চাপে আমার পরিবারের দিশেহারা অবস্থা।’
ঢাকা উদ্যান পাবলিক হাইস্কুলের এক শিক্ষার্থীর অভিভাবক বলেন, ‘আমার হতদরিদ্রের সংসার। শুনতাছি ১০ হাজার ট্যাকা পরীক্ষার ফিশ লাগব। ঘরভাড়া, খাওয়ার ট্যাকা জোগাড় করতে ঘাম ছুইট্যা যাইতাছে, ক্যামনে এই ট্যাকা জোগাড় করমু!’
অবৈধ সব বিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ডের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদপুর থানা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা রাজু আহমেদ বলেন, ‘ঢাকা উদ্যানের দুটি স্কুল ছাড়া সবগুলোই অনুমোদনহীন। ফলে তারা আমার নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
অতিরিক্ত ফি আদায় প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘বিষয়টি আমি প্রথম শুনলাম। কালই (আজ রবিবার) পরিদর্শন করে ব্যবস্থা নেব।’
অন্যদিকে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের বিদ্যালয় পরিদর্শক আব্দুল মনছুর ভুঁইয়া বলেন, ‘বিদ্যালয়ে অতিরিক্ত টাকা নেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আমরা এ বিষয়ে বিজ্ঞপ্তি দিয়ে সব বিদ্যালয়কে জানিয়েছি। তারপরও যদি কেউ নেয় তাহলে অভিভাবকদের লিখিত অভিযোগ দেওয়ার অনুরোধ করছি।’
করোনা পরিস্থিতিতে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ আছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। সবশেষ আগামী ৩০ মার্চ খুলে দেওয়ার কথা থাকলেও করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধির কারণে ঈদের পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী এ বছরের জুনে এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষা জুলাই-আগস্ট মাসে হওয়ার কথা রয়েছে। – দেশ রূপান্তর