রোকসানা ইয়াছমীন
মার্চের শেষের দিকে, মুক্তিযুদ্ধ তখন শুরু।গ্রামের মেঠোপথের ধারে ২৫ বৎসরের যুবতী ভানু নেছা সাংসারিক কাজ সারার লক্ষ্যে বাড়ির বাইরে গেলো। চৈত্রের খরতাপের রোদ্রে গ্রামের মেঠোপথের ধারে হাটতেছিলো ভানু।হঠাৎ চমকে উঠে সে, একি!এরা কারা? পরে বুঝে নেয়, “মনে অয় এরাই পাকিস্তানি মিলিটারি। ওমা! সবুজ রঙের গাড়ী লইয়া হন, হন কইরা আইতাছে,ব্রিজটার উপর দিয়া, আমি এহন কি পালামু? কি করমু তাহলে? না পালানো যাইবো না” এই ভাবতে,ভাবতে হঠাৎ তাঁর মাথায় বুদ্ধি
এলো” আমি তো গেরামের মাইয়া গাছে উঠতে পারি, গাছটায় উঠলে এরা কোনহানে যায় বুজবার পারমু” ভানু নেছা চট্ করে পরনের শাড়ীটি গুঁজে নিকটের একটি বড় গাছে উঠে পড়লো আরব্য রজনী উপন্যাসেের নায়িকার মতো, আর চল্লিশ চোর হানাদারবাহিনীর গতিবিধি লক্ষ করার জন্য।
তিনি দেখলেন মিলিটারি দের একটি গাড়ী ব্রিজটার উপর দিয়ে পুর্ব দিকে চলে যাচ্ছে,
কোথাও মুক্তিফৌজ খোঁজার উদ্দেশ্যে।তারা প্রস্থান করার পর,পর চট্ করে গাছ থেকে লাফ
দিয়ে নেমে পড়লো। গাছ থেকে নেমে ভানু গ্রামের
সবাইকে ডাক দিলো “ওরে তোমরা কে কোনায় আছ, আলতাফ ভাই,মুমিনুল, লতিফ তোমরা
তাড়া কইরা আহ,মিলিটারি পাঞ্জাবী’রা ব্রিজ পার
হইয়া পূর্ব দিকে গেছে,শেখ মুজিব আমাদের বলেছেন রেডিও’তে হুনছি,” তোমাগো যা আছে
তা লইয়া শত্রু’গো মোকাবেলা কর”আমাগো
ওই মিলিটারি দের এদেশ থেইক্যা তাড়াইতে অইবো”। সবাই ভানুর চিৎকার শুনে জড় হলো।
আলতাফঃ” কি ব্যাপার কি অইছে ভাবীছাব?”
মুমিনুলঃ ” মিলিটারি কি আইয়া পড়ছে?”
ভানুনেছাঃ” কোন কতা নাই আগে সবে মিল্যা
ঐ ব্রিজ খান ভাঙি দাও,,পরে পজিশন নাও,
ব্রিজ না ভাঙলে ওরা গেরামে ঢুইক্যা পড়বো।
সত্যিই সেদিন ভানুর কথায় ব্রিজ না ভাঙলে
পাকিস্তানি মিলিটারি’দের প্রতিহত করা বেশ
মুশকিল হতো।
বাংলা মায়ের এ দুঃসাহসী সন্তান ভানুনেছা পাবনার সাঁথিয়া উপজেলা’র ধোপাদহ ইউনিয়নের
তেতুলিয়া গ্রামের আব্দুল প্রামাণিকের স্ত্রী। অল্প বয়সে স্বামী হারা হন এই নারী। স্বামী’র বিয়োগান্তে
দুই ছেলে এক মেয়েকে কষ্ট করে লালন করেন।
যুদ্ধ শুরু হলো প্রচণ্ড তাণ্ডব নিয়ে। লতিফ, কমান্ডার ও অনান্য মুক্তিযোদ্ধাদের ভানু’কে
অস্ত্রের ব্যাপারে সহযোগিতা চাইলে ভানু বলে উঠলেন “ওই পাকবাহিনী লোক গুলাকে হঠাইতে
আমি যা পারমু করমু,তোমরা চিন্তা কইরো না,
কহন কি লাগে তোমরা শুধু বলবা আমারে”।
এর পর ভানু কয়েকজন এর সহযোগিতায় অভিনব কায়দায় গোলাবারুদ ও অস্ত্র সংগ্রহ করে,এবং সেগুলো জুড়ির মধ্যে রেখে উপর দিয়ে গোবর দিয়ে ঢেকে গ্রাম্য অতি সাধারণ বেশ ধরে মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকারে( মাটির গর্ত, যার উপর দিয়ে টিনের ছাউনি) বাংকারে গিয়ে সেগুলো দিয়ে
আসতো।তাদের প্রয়োজনে খাবার সংগ্রহ করতো।
এসব করতে গিয়ে তাঁকে একবার পায়ে গুলিবিদ্ধ
হতে হয়,তার পরও এ দুঃসাহসী নারী মুক্তিযোদ্ধাদেরসহযোগিতা থেকে সরে আসেন নি। যুদ্ধ শেষ হওয়া অবধি তিনি মুক্তিযুদ্ধে এভাবেই নিজেকে উৎসর্গ করেছিলেন।এ রকম করে অজ পাড়া গাঁয়ের এই বুদ্ধিমতী ভানুনেছা দেশ স্বাধীন করেন।
যুদ্ধ শেষ হলো দুই যুগের ও বেশি সময় কেটে গেলো ভানুনেছা ‘র আর কেউ খোঁজ করেন নি। অবশেষে ১৯৯৬ পর থেকে প্রেস মিডিয়া সবে খোঁজ করতে শুরু করলো।
ভানু বললো” হ দেশ স্বাধীন করছি শেখ মুজিবের আদর্শে।,শেখ হাছিনা ভাতা দিতেছে সে গুলায় চলতেছি, একখান টিনের চালের ঘর দিছে।”
১৯৯৬ সালে তাঁকে সরকারী ও বেসরকারি ভাবে
সন্মানিত করা হয়।
এরপর আর কেউ খোঁজ করেনি ভানুনেছা’র।
অন্য সাধারণ মুক্তি্যোদ্ধার মতই ভাতা পেতেন।
২০২০ সাল থেকে ভানুনেছা খুবেই অসুস্থ হয়ে পড়েন।পক্ষাঘাতে বাক শক্তি হারিয়ে শয্যাশায়ী
হয়ে পড়েন ভানু। চিকিৎসা ছিলো উপজেলা
কমপ্লেক্স পর্যন্ত। তাঁর দিন মজুর দু সন্তান চিকিৎসা ব্যয়ভার বহন কষ্টসাধ্য ছিলো।
স্বাধীনতা যুদ্ধে জয়ী এই মহিয়সী নারী ২০২১ সালের ২৬শে ফ্রেব্রুয়ারি মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ে
হেরে গিয়ে ৭৫ বছর বয়সে বাংলার শ্যামল মাটিতে
চিরনিদ্রায় শায়িত হন।