নিঝুম মজুমদার: জোসেফ-হারিস-আনিস-আজিজ-টিপু সাহেব কিংবা তাঁদের ৩ বোন অথবা তাঁদের বাবা ওয়াদুদ সাহেব এবং মা রেনুজা বেগমের জীবনটাই শুরু হয়েছে এই তিলোত্তমা ঢাকায় এক দুঃস্বপ্ন দিয়ে।

ওয়াদুদ সাহেব বাংলাদেশ বিমানের উর্ধতন কর্মচারী ছিলেন। হাউজ বিল্ডিং থেকে ঋণ নিলেন, গ্রামের কিছু যায়গা জমি বিক্রি করলেন। ঢাকার মোহাম্মদপুরে একটা দোতলা বাড়ী কিনলেন পুরো পরিবার নিয়ে থাকবার জন্য। এই গল্প ৮০-এর দশকের শেষ কিংবা ৯০ এর দশকের শুরুর।

দখল হয়ে গেলো বাড়িটি। এতগুলো ছেলে মেয়ে নিয়ে পুরো পরিবার রাস্তায়। মেঝো ভাই আজিজ তখন খুব সম্ভবত ক্যাপ্টেন কিংবা মেজর। তাঁর পোস্টিং হয়েছে ঢাকার বাইরে। তাঁদের পিতা গ্রামে গেছেন কিছু জমি বিক্রি করতে, ঋণের কিছু অংশ শোধ করবার জন্য গ্রামের জমি বিক্রি করতে। ঠিক এই সময়ে ঘটে এই দখলের গল্প।

জোসেফ এই শহরটাতে জীবন যাপন শুরু করেছিলো আমার-আর আপনার মত একেবারেই সাধারণ তরুনের মত। জোসেফ নিজেও অসম্ভব ভালো ছাত্র ছিলেন। আজিজ নিজের মহিমাতেই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে চলে গেলেন। নিজের ক্যারিয়ার গড়তে লাগলেন।

বড় ভাই আনিস পুরো পরিবারকে উঠাবার চেষ্টা করেন বাবার সাথে। হারিসও রাজনীতিতে অল্প অল্প করে ঢুকছেন, নিজের একটা প্রতিবিম্ব তৈরী করবার চেষ্টা করছেন এই শহরে। টিপু ঘরের শান্ত ছেলে। সব থেকে মেধাবী আর যুক্তির আবরণে মোড়া সে। কিছুটা আবেগে আক্রান্তও। একেবারে উচ্চ মাধ্যমিকে থাকতেই বোধকরি প্রেম করে বিয়ে করে ফেলে।

দখল হয়ে যাওয়া বাড়ি নিয়ে রাস্তায় নামে পুরো পরিবার। সেনাবাহিনীর কর্মকর্তা আজিজ স্টাফ কলেজ থেকেই দীর্ঘঃশ্বাস ছাড়েন। সরকারি চাকুরী করেন। পরিবারের এসব গল্প শোনেন আর চুপ-চাপ ভাবেন। সব কিছুর পরেও এই পরিবারের তিনবোনকে আগলে ধরে রাখেন সব ভাইয়েরা।

৯১ কিংবা ৯২ এর দিকের ঘটনা। মোহাম্মদপুরের শীর্ষ সন্ত্রাসী মোর্শেদ জোসেফের পিঠের পেছন দিয়ে ছুরি ঢুকিয়ে দেয়। কি অপরাধ জোসেফের? কিছুই না।

May be an image of 2 people, people standing, outdoors and text that says 'WE ALL ARE SHEIKH HASINA'S MEN'

নিঝুম মজুমদার।

মোর্শেদের কিছু সাগরেদকে জোসেফ ভাই বলেনি কিংবা মান্য করেনি, এই হচ্ছে জোসেফের অপরাধ। ব্যাস সেই শুরু। জোসেফ তখন অল্প অল্প করে ছাত্রলীগের রাজনীতিতে ঢুকেছে।

বিএনপির আমল। জোসেফ ছাত্রলীগ করে। হারিস যুবলীগের রাজনীতিতে থিতু হতে চাইছে, বড় ভাই আনিস ব্যাবসা নিয়ে, পরিবারটিকে টেনে তুলবার জন্য যুদ্ধে অবতীর্ণ, মেজো ভাই আর্মিতে।

বিএনপি আমলে সমস্ত ক্ষমতা দেখায় মোর্শেদ। জোসেফকে আজকে রাস্তায় পেটায় তো কালকে পেছন থেকে মাথা ফাটিয়ে দেয়। হারিস ঘরে থাকতে পারেনা।

ছুরি ঢোকাবার পর সেটি অনেকটা ছিন্ন-ভিন্ন করে দেয় জোসেফকে।

ফুস্ফুস ক্ষতিগ্রস্থ হয় তাঁর। দীর্ঘদিন সে যন্ত্রণায় কাটিয়েছে, আজকেও কাটায়। ইনফ্যাক্ট জেলের দীর্ঘ সময় সেই ৯০ দশকের ছুরির আঘাত তাঁকে ছাড়েনি। ৯০ এর দশকে মোর্শেদের সন্ত্রাস বাহিনী পেছন থেকে রডের বাড়ি দিয়ে মাথার পেছনটা থেঁতলে দিয়েছিলো। সেখান থেকেও বেঁচে ফিরেছে জোসেফ।

এক সন্ধ্যায় মোর্শেদ আর তার বাহিনী জোসেফদের মোহাম্মদপুরের বাসাটা আক্রমণ করে বসে। জোসেফ কিংবা হারিস কিংবা আনিস কেউই ছিলোনা বাসায়। ব্রাশ ফায়ার করে নরক কুন্ড বসিয়ে দেয় ওয়াদুদ সাহেবের বাড়িতে। কোনো বিচার পায়নি ওরা বিএনপি’র আমলে।

সে সময় আরো প্রভাবশালী ছিলো সলু, সেতুসহ মোহাম্মদপুরের আরো অনেক আত কিংবা পাতি নেতারা।

১৯৯৩ সালে না ফেরার দেশে চলে যান ওয়াদুদ সাহেব।
জোসেফ-আনিস-হারিস-আজিজ-টিপু’র বাবা। পুরো পরিবারের মাথার উপর থেকে সরে যায় এক বটবৃক্ষ।

এই সমাজ বাস্তবতা, এই নিষ্ঠুর মানুষেরা, এই রাজনীতি, এই জীবন জোসেফকে নিয়ে এসেছে প্রতিশোধের জীবনে। জোসেফের পিঠ দেয়ালে ঠেকে যায়। জোসেফও পালটা আঘাত করে। হারিসও করে। আর কত পালিয়ে থাকা? আর কত অত্যাচার সহ্য করা। বোনেরা স্কুলে যেতে পারেনা, দুইদিন পরপর বাসায় আক্রমণ, পুলিশ পাঠানো। পুরো পরিবার অতিষ্ঠ।

একদিন বড় ভাই আনিস সাহেব বিছানার সাথে লাগানো মশারির স্ট্যান্ড খুলে জোসেফকে পেটান। পেটাটে পেটাতে সিদ্ধান্ত নেন, মেরেই ফেলবেন আজকে জোসেফকে। তাঁর একটাই কথা, ‘তুই কেন এসবে গেলি? কে তোকে বলেছে রাজনীতি করতে?’

আমরা এই গল্পে যে জোসেফকে দেখতে পাচ্ছি সেই জোসেফের নানা জন্ম হয়েছে। জন্ম আর পুনঃজন্ম হতে হতে আজকে আপনারা নাম দিয়েছেন সন্ত্রাসী জোসেফ। কিন্তু আমরা যারা মোহাম্মদপুরে বড় হয়েছি, আমরা যারা আদাবর-শ্যামলীতে বড় হয়েছি, যেখানে আমাদের নাড়ি পোতা আমরা জানি এই পরিবারের গল্প। আমরা এই পরিবারটিকে জানি।

জোসেফ কিংবা হারিস অন্যায় অপরাধের সাথে একটা পর্যায়ে যুক্ত হয়নি, এই দাবী আমি করবোনা। আঘাত খেতে খেতে, অত্যাচার সহ্য করতে করতে অন্ধকার দেখলে বোনকে জড়িয়ে রাখা জোসেফ, একা ঘুমাতে না পারা সবার আদরের ভাই জোসেফ ততদিনে পাল্টা আঘাত দিতে শিখে গেছে।

আইন-কানুন-নিয়ম-নীতি সব কিছুর আবরণে আমরা জোসেফ কিংবা হারিসকে বলি সন্ত্রাসী। হয়ত বলাই যায়। কিন্তু এই ভেতরের গল্প কয়জন জানে?

আনিস সাহেব ব্যবসার কাছে তখন ঢাকার বাইরে। কিন্তু মোস্তাফিজ হত্যাকান্ডে বড় ভাই আনিসের নামটা ঢুকিয়ে দেয়া হোলো। এই পরিবারের সবচাইতে শ্রদ্ধেয় ভাই তাঁদের। যিনি বাবার আদরে প্রতিটি সন্তানকে দেখভাল করছেন। তাঁকেও মিথ্যে মামলায় করে দেয়া হোলো আসামী। করা হলো গ্রেফতার।

শেখ হাসিনা’স ম্যান? হাসি পায়…

১৯৯৬ সালে তিন ভাইকেই গ্রেফতার করা হলো। চার্জশীট দেয়া হোলো। একটা পর্যায়ে তো বড় ভাই আনিসকে বঙ্গবন্ধুর খুনী মোসলেহ উদ্দিন বলে কিছুদিন হয়রানিও করা হলো। আর দুঃস্বপ্নের মত সে এলাকার তৎকালীন প্রভাবশালী এমপি হাজী মকবুল তো জন্মান্তর ধরে এই পরিবারের পেছনে লেগেই রয়েছে।

১৯৯৯ সালে আওয়ামীলীগ আমলেই শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমন মেরে ফেললো এই পরিবারের সবচাইতে মেধাবী আর শান্ত ছেলেটিকে। টিপুকে। রাস্তায় পড়ে থাকে টিপু। আরো একটি নাম উঠে আসে সাথে সাথে। বিহারি জাভেদ।

বলা হয় টিপু কোথায় যাবে, কিভাবে যাবে কিংবা জোসেফ কোথায় আছে, কি করে কিংবা এই পরিবারের প্রতিটা সংবাদ প্রতিপক্ষের কাছে দিয়ে আসে জাভেদ। এই পরিবারের ঘনিষ্ঠ সেজে পেছন থেকে ছুরি চালায়।

টিপু হত্যার বিচার নিয়ে আমরা একটি কথাও বলেছি কি? আমরা একটি বারের জন্য টিপুকে হত্যার কারন জানতে চেয়েছি কি? উত্তর হচ্ছে, চাইনি। কারন আমাদের মন-মগজ আর মজ্জায় রয়ে গেছে টিপুর ভাই জোসেফ। আর জোসেফকে সবাই সন্ত্রাসী হিসেবেই জানে ফলে টিপু মরে গেছে ভালো হয়েছে। এইতো কথা?

জোসেফ কি নানাবিধ অপরাধের সাথে ছিলো? কিংবা হারিস? নির্মোহভাবে দেখতে গেলে এই কথা অস্বীকার করবার উপায় বোধকরি নেই যে জোসেফ কিংবা হারিসকে আমরা নানা অভিযোগে অভিযুক্ত করতেই পারি। কিন্তু জোসেফের মত মেধাবী কিংবা ঘরকুনো ছেলেটা এই পথে এলো কেন?

কেন তাকে এই প্রতিশোধের রাস্তায় আসতে হোলো? আমরা কি সেটি কোনোদিন ভেবে দেখেছি? জোসেফ, এই পরিবারের উপর অত্যাচার আর অনাচার দেখে এই পথে পা বাড়াতে বাধ্য হয়েছেন, এই সত্যটা আমরা স্বীকার করতে আসলে ভয় পাই। আমাদের কুন্ঠা হয়। আমাদের এই বিখ্যাত কুন্ঠা আমাদের সত্য খুঁজতে বাঁধা দেয়।

যে জোসেফ অন্ধকার দেখলে ছোটবোনটাকে জড়িয়ে ধরতেন, যে মানুষটা একা খেতে পারতেন না, একা থাকতে পারতেন না সে মানুষটাকে অন্ধকার জীবনে পা বাড়াতে হয়েছে। অন্ধাকার জেলে ২২ টি বছর কাটিয়ে দিতে হয়েছে। কৈশোর, তারুন্য আর যৌবন সব শেষ করে দিয়েছেন তিনি।

আমার মনে আছে একই গল্প ছিলো কালা জাহাঙীরেরও। ম্যাট্রিক পরীক্ষায় স্টার মার্ক্স পাওয়া ছেলেটি কিভাবে রাস্তায় মার খেয়ে প্রতিশোধ নিতে গিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে নাম লিখিয়েছিলেন। সেটিও জানি আমরা। জাহাঙ্গীরের মা ছিলেন স্কুল শিক্ষিকা। ভাই ছিলেন আর্মিতে। সবারই গল্প থাকে এমন।

এমন একটি সংগ্রামী পরিবার থেকে আজিজ আহমেদ উঠে এসেছিলেন। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গেছেন জীবনের এতটা বছর।

বিএনপি আমলেও তাঁর পদন্নোতি হয়েছিলো, আবার হয়েছিলো আওয়ামীলীগ আমলেও। অথচ সাধারণ মানুষদের যেখানে বলবার কথা যে, এমন একটি বিপদ শংকুল অবস্থা থেকেও যেই লোকটি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান হতে পারেন, আমরা তাঁকে স্যালুট জানাই। কিন্তু মানুষ সেটা করেনি।

জোসেফের ভাই কেন সেনা প্রধান হবে? এই হচ্ছে আমাদের জনতার বেশীরভাগের প্রশ্ন। মানে দাঁড়াচ্ছে, এই সমাজ জোসেফ তৈরী করবে আবার এই সমাজ একজন আজিজ তৈরী হতে দেবে না। মাঝে মধ্যে এই সমাজের গায়ে গলা খাকারি দিয়ে থুতু দিতে ইচ্ছে হয় আমার। এই ভ্রষ্ট সমাজ, এই নোংরা সমাজ বড় নিষ্ঠুর। বড় কুৎসিত।

এতটা অন্ধকার এই পরিবারকে পার হতে হয়েছে অথচ সব কিছুর পরেও ভাইয়েরা এই পরিবারের বোনদের ঘিরে রেখেছিলেন সমস্ত মমতা দিয়ে। উচ্চ শিক্ষায় শিক্ষিত করেছেন বোনদের।

এই পরিবারের বড় ছেলে আনিস কিছু না করেও জীবনের একটা বড় সময় পালিয়ে বেড়িয়েছেন মিথ্যে মামলা কাঁধে নিয়ে। যিনি ঘটনার সময় ছিলেন-ই না, তিনিও হয়ে গেলেন হত্যা মামলার আসামী। হয়ে গেলেন ফেরারী। এই-ই জীবন…

আচ্ছা আপনারাই বলেন তো, ৯ টা গুলি খাবার পরে একজন ব্যাক্তি কি করে বলতে পারে হারিস তার লাইসেন্স করা পিস্তল থেকে তাকে গুলি ছুঁড়েছে? ইনফ্যাক্ট ৯ টা নয়, ১ টা গুলি খেয়েও তো বলা সম্ভব না এটা লাইসেন্স করা পিস্তল নাকি অবৈধ পিস্তল!

যে লোক মৃত্যু পথে, তিনি কি করে বলেন কিংবা কি করে এমন নিঁখুত বর্ণনা দেন তাঁকে কে কে মেরেছে?

আচ্ছা যেই মোস্তাফিজ নিহত হয়েছে, তার কোমরেই বা কি করে একটি রিভলবার থাকে? আর সেই রিভলবার দিয়েই কি করে জোসেফ তাকে গুলি করে? সেই রিভলবার কি বৈধ ছিলো? তাহলে জোসেফ কি তাকে মারাতে যাবার সময় পিস্তল নিয়ে যায়নি? তাহলে কি জোসেফ খালি হাতে তাকে মারতে গিয়েছিলো?

কত প্রশ্ন, কত কৌতুহল…সব কিছুই আপনাদের সামনে আনবো একটা একটা করে। মামলার কপিগুলো হাতে আসুক…

একবার যখন হাত দিয়েছি তখন পুরো গল্প-ই শেষ করে যাবো। গল্প অর্ধেক কেন জানবে মানুষ? পুরোটাই জানুক। পুরোটাই বুঝুক।
লেখক, যুক্তরাজ্য প্রবাসী আইনজীবি, লেখক ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক

কি করে আনিস সাহেবরা ফেঁসে যায়, কি করে জোসেফ কিংবা হারিসরা সন্ত্রাসী বলে পরিচিতি পায়, এই গল্প সবারই জানা থাকা দরকার।

লেখাটি লেখকের ফেসবুক থেকে নেওয়া।

https://www.facebook.com/nijhoom.majumder/posts/3885376244884380

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *