প্রায় ১৪ বছর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে বিভিন্ন ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে বেআইনিভাবে নেওয়া এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংকে এখনো পড়ে আছে। দেশের উচ্চ আদালতের শরণাপন্ন হয়েও টাকা ফেরত পাচ্ছেন না ভুক্তভোগীরা। আপিল ও রিভিউয়ের পর আবার আপিল আবেদন—আইনের এই সুযোগ নিয়ে বিপুল পরিমাণের এই অর্থ আটকে রেখেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক।

এই টাকা নিয়ে মামলায় বাংলাদেশ ব্যাংক একবার আপিল বিভাগে হেরে গেলেও দ্বিতীয় দফায় করা আপিল শুনানি করছে না দুই বছর ধরে। মামলা নিষ্পত্তিতে সরকারপক্ষও নিশ্চুপ। এ অবস্থায় এসব টাকা প্রকৃত মালিকদের ফেরত দিতে সরকার দ্রুত বাস্তবমুখী পদক্ষেপ নেবে বলে প্রত্যাশা করছেন ভুক্তভোগীদের আইনজীবীরা। আপিল বিভাগে জনগুরুত্বপূর্ণ মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তিতে সংশ্লিষ্ট পক্ষ পদক্ষেপ নেবে বলে তাঁরা আশা করছেন।

আপিল শুনানির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে কি না, সে বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের কাছে জানতে চাইলে তিনি কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি ক্ষমতায় আসা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় দেশের বেশ কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ ছাড়া ওই বছরের এপ্রিল থেকে ২০০৮ সালের নভেম্বরের মধ্যে প্রায় ৪০ ব্যক্তি ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা করে সরকার। দুই শতাধিক পে-অর্ডারের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকে সরকারের ০৯০০ নম্বর হিসাবে জমা করা হয় টাকাগুলো। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিদায়ের পরপরই ২০০৯ সালে ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফেরত চেয়ে পৃথক ১১টি রিট আবেদন করেন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা। এর পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট ২০১২ সালে এক রায়ে টাকা ফেরত দিতে বাংলাদেশ ব্যাংককে নির্দেশ দেন। একাধিক রিট আবেদনের কারণে হাইকোর্ট ভিন্ন ভিন্ন সময়ে রায় দেন। এ রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংক আপিল বিভাগে আপিল করার অনুমতি চেয়ে আবেদন করে। আপিল বিভাগ ২০১৫ সালে আপিল করার অনুমতি দিলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিয়মিত আপিল দাখিল করে। এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে ২০১৭ সালের ১৬ মার্চ রায় দেন দেশের সর্বোচ্চ আদালত। রায়ে তিন মাসের মধ্যে টাকা ফেরত দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়, কিন্তু টাকা না দেওয়ায় টাকা ফেরত চেয়ে ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আবেন করেন। এর পরও টাকা ফেরত না দেওয়ায় ওই বছরের ৮ আগস্ট আদালত অবমাননার মামলা করেন ব্যবসায়ীরা। এরপর ২৯ আগস্ট বাংলাদেশ ব্যাংক রিভিউ আবেদন করে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আপিল বিভাগ বাংলাদেশ ব্যাংককে পুনরায় আপিল করার নির্দেশ দেন। এরপর ২০১৯ সালে দ্বিতীয় দফা আপিল আবেদন করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, যা এখন আপিল বিভাগে বিচারাধীন।

জানা গেছে, বাকি ৬১৬ কোটি ৪৫ লাখ টাকা ফেরত চেয়ে সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যবসায়ীরাও হাইকোর্টে রিট আবেদন করেছেন, যা এখন বিচারাধীন। কার্যত আগে করা মামলায় আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় আছেন এ রিট আবেদনকারীরা।

২০১৭ সালে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে বলা হয়, রিট আবেদনকারীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে আইনগত কোনো বাধা নেই। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে আদায় করা এসব অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা যেমন ঝুঁকিপূর্ণ, তেমনি ভয়ানক বিপদও। দেশ থেকে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ওই টাকা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের ফেরত দিতে পারত।

এ টাকা ফেরত দিতে হলে সংসদে আইন পাস করতে হবে—বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে আইনজীবী ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলামের এ বক্তব্য খণ্ডন করে রায়ে বলা হয়, এ যুক্তি গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ জোর করে আদায় করা ওই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি হিসাবে (নম্বর : ০৯০০) জমা রয়েছে। কোনো আইন ছাড়াই জনগণের কাছ থেকে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে আদালতের নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। এ ছাড়া টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদে আইন করার প্রয়োজন নেই।

আপিল বিভাগে বিচারাধীন মামলায় ব্যবসায়ীদের পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট আহসানুল করিম কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘এই মামলা জনগুরুত্বপূর্ণ মামলা। এখানে ব্যবসায়ীদের অনেক টাকা ঠুনকো অজুহাতে আটকে রাখা হয়েছে বছরের পর বছর। এই টাকার বৈধ মালিক ব্যবসায়ীরা। বিপুল পরিমাণ টাকা আটকে থাকার কারণে ব্যবসায়ীরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। তাই আশা করি, এই মামলা দ্রুত নিষ্পত্তিতে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

আরেক আইনজীবী ব্যারিস্টার খায়রুল আলম চৌধুরী কালের কণ্ঠকে বলেন, দেশের কোনো নাগরিকের কাছ থেকে রাষ্ট্র যদি কোনো অর্থ নেয় তবে রাষ্ট্রকে আইন করেই বা আইনের ক্ষমতাবলেই অর্থ নিতে হয়। যেমন মূল্য সংযোজন কর (ভ্যাট), আয়কর, অগ্রিম আয়কর, শুল্কসহ বিভিন্ন খাতে যে অর্থ ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের জনগণের কাছ থেকে রাষ্ট্র নেয়, তা আইন করেই নেয়। কিন্তু ওয়ান-ইলেভেনের (বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার) সময় ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে যে এক হাজার ২৩২ কোটি টাকা নেওয়া হয়েছে তা কোনো আইনি কাঠামোর মাধ্যমে নেওয়া হয়নি। এসব টাকার ওপর ব্যবসায়ীরা যথারীতি করও দিয়েছেন।

ব্যারিস্টার খায়রুল বলেন, ‘বাংলাদেশ ব্যাংক অতি উৎসাহী হয়ে ব্যবসায়ীদের টাকা আটকে রেখেছে। আপিল বিভাগ একবার রায় দিয়ে বলে দিয়েছেন যে কোনো আইন ছাড়াই টাকা নেওয়া হয়েছে, তাই এই টাকা ফেরত দিতে নতুন করে আইন করার প্রয়োজন নেই। এর পরও বাংলাদেশ বাংক সময় ক্ষেপণ করছে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *