ছিপছিপে গড়ন, বয়স ৩৭। পুরো নাম নুরুল আলম নুরু। কুমিল্লার ছেলে নুরুর বেড়ে ওঠা চট্টগ্রামে। শরীরের নোনা জল ফেলে, গতর খেটে তাঁর কর্মজীবনের শুরুটা ছিল শ্রমিক হিসেবে। তবে কাঁচা টাকার নেশায় শ্রমিকের কাজে মন বসেনি তাঁর। একসময় পাহাড় কাটায় মজেন নুরু। তিনিই চট্টগ্রামের পাহাড়খেকোদের ‘গুরু’। তাঁর শকুনি চোখ যে পাহাড়ে পড়েছে, পলকে সেখানেই রং হারিয়েছে সবুজ। সময়ের হাত ধরে তিনি হয়ে ওঠেন ‘পাহাড় ডন’। তাঁর আগ্রাসনে পাহাড়ও যেন নীরবে কাঁদে! একই সঙ্গে অপরাধের নানা অন্ধকার পথেও হাঁটেন তিনি। একের পর এক পাহাড় খেয়ে নুরু এখন টাকার পাহাড়ের চূড়ায়।
পাহাড় কেটে সমান করে অন্যকে বিক্রি করা কিংবা টাকার বিনিময়ে অন্যের দখল করা পাহাড় কেটে দেওয়ায় ছিল তাঁর পেশা আর নেশা। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কড়া শাসনে এই নুরু এখন চৌদ্দ শিকে বন্দি। গত ৮ জানুয়ারি নোয়াখালী থেকে পুলিশ তাঁকে গ্রেপ্তার করে।
কনকর্ড নামে যে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শ্রমিক হিসেবে কর্মরত ছিলেন নুরু, সেই প্রতিষ্ঠানের অধিগ্রহণে নেওয়া পাহাড়ই বেশি কেটেছেন তিনি। তবে কনকর্ডের লিজ পাওয়া এই জমির মূল মালিক বাংলাদেশ রেলওয়ে।
নুরুর বসতি চট্টগ্রাম মহানগরীর আকবর শাহ থানার নাছিয়া ঘোনা ১ নম্বর ঝিল এলাকায়। একসময়ের শ্রমিক নুরু শুধু পাহাড় কেটেই ক্ষান্ত হননি, নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে নাছিয়া ঘোনায় নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। ওই এলাকায় তাঁর অনুমতি ছাড়া কিংবা অপরিচিত কেউ ঢুকতে পারত না। ঘোনায় প্রবেশের আগে প্রধান ফটকে তাঁর নিজস্ব বাহিনীর সদস্যের জেরার মুখে পড়তে হতো সাধারণ মানুষকে। পরিচয় নিশ্চিত হলেই সীমানা পারাপারের অনুমতি, না হলে ফিরতে হতো ফটক থেকেই। তাঁর এলাকায় পুলিশও ছিল একরকম অসহায়!
অনুসন্ধানে জানা যায়, এক যুগ ধরে নাছিয়া ঘোনা নুরুর কবজায়। অর্ধশতাধিক সন্ত্রাসী নিয়ে নিজস্ব বাহিনী গড়ে তুলে নুরু পাহাড় কাটাসহ নানা অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। এলাকায় আধিপত্য জারি করে নুরু ধারাবাহিকভাবে পাহাড় কেটেছেন। প্লট তৈরি করে মানুষের কাছে বিক্রি করেছেন। নুরু পাহাড় কাটা বৈধ করতে ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সাইনবোর্ডও ঢাল হিসেবে ব্যবহার করতেন। এসব কাজে ব্যবহার করা হতো অবৈধ অস্ত্র। শেষ পর্যন্ত অস্ত্র মামলায় তাঁর ১৭ বছরের কারাদণ্ডও হয়েছিল। কিন্তু সেই সাজার পরোয়ানাও দীর্ঘ দুই বছর গোপন রাখার বন্দোবস্ত করেছিলেন নুরু।
নুরুর বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ পেয়ে গত ২৬ ডিসেম্বর ওই এলাকায় অভিযানে গিয়েছিল পুলিশ। ওই সময় নুরুর নেতৃত্বে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা ঘটেছিল। তখনই পাহাড় কাটার বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে। এরপর ৩১ ডিসেম্বর আকবর শাহ থানায় মামলা করে পরিবেশ অধিদপ্তর। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, পাহাড়তলী মৌজার বিএস ৩৪২০ দাগের জায়গাটি পাহাড় শ্রেণিভুক্ত। এই পাহাড় কাটেন নুরুল আলম নুরু।
সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনি এলাকায় পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে বসতি, রেলওয়ে ও ব্যক্তিমালিকানাধীন পাহাড় কাটা হয়েছে অবাধে। ঝিলে পাহাড় কেটে তৈরি হয়েছে গাউসিয়া লেকসিটি নিউ আবাসিক এলাকা। ওই আবাসিকেই মূলত বহিরাগতদের প্রবেশ ছিল ‘অঘোষিত’ নিষিদ্ধ। শুধু সেখানকার বাসিন্দারাই যেতে পারত আবাসিকে। সেখানে গড়ে তোলা হয়েছে সন্ত্রাসীদের আস্তানা। সেই আবাসিকে নিজস্ব বাড়ি, পাহাড় কেটে প্লট তৈরি, অন্যের ঘর তৈরির সরঞ্জাম সরবরাহসহ নানাভাবে টাকা আয় করে কোটিপতি বনেছেন নুরু।
দেখা গেছে, পাহাড় কেটে যে নিউ আবাসিক এলাকা তৈরি করা হয়েছে, তার প্রবেশমুখে গেট তৈরি করা হয়েছে। গেটের আশপাশে তৈরি হয়েছে ভবন। ভবনগুলোর মালিক সিরাজুদ্দৌলাহ, মো. নুরনবী ও মাহবুবা ইয়াছমিন ডলি। তাঁদের একজন ডলি বলেন, ২০০৯ সালে তাঁর প্রবাসী স্বামী গোলাম মাওলা নামের একজনের কাছ থেকে ৪৫ লাখ টাকা দিয়ে জমি কিনে বাড়ি তৈরি করেছেন। আর স্থানীয় লোকজন জানিয়েছে, এই পাহাড় কেটে প্লট তৈরি করে দেওয়ার কাজটিই করেছেন নুরু। শুধু পাহাড় কাটা নয়, বাড়ি তৈরির প্রয়োজনে ইট, বালু, রড, সিমেন্ট সরবরাহের কাজটিও করতেন তিনি। এভাবেই নুরু কামিয়েছেন কোটি কোটি টাকা।
আকবর শাহ থানার ওসি জহির হোসেন বলেন, আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ কলোনির পাহাড়ি এলাকাটি স্থানীয় লোকজনের কাছে ঝিল নামে পরিচিত। এই ঝিলগুলোতেই একসময় ছিন্নমূল মানুষের বসতি শুরু হয়েছিল পাহাড় কেটে। এখন সেখানে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ বাস করছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের চট্টগ্রাম মহানগরের পরিচালক নূরুল্লাহ নূরী কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘পূর্ব ফিরোজ শাহ এলাকার পাহাড়গুলোর বেশির ভাগই বেসরকারি। কিছু পাহাড় আছে রেলওয়ের। এসব পাহাড় নিয়ে আদালতে মামলা চলছে।’ তিনি বলেন, ‘নুরু ও তার সহযোগীদের নামে মামলা হয়েছে। এই মামলায় নুরু গ্রেপ্তার হয়েছে।’