সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন নির্বাচনের তুলনায় প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে ভোটের হার বেড়েছে। নির্বাচন কমিশনের তথ্য অনুযায়ী, গত সোমবার অনুষ্ঠিত ২৩টি পৌরসভার নির্বাচনে ভোট পড়ে ৬৫ দশমিক ০৬ শতাংশ।
ফলাফল বিশ্লেষণে দেখা যায়, তৃণমূলের এই নির্বাচনেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপির ভরাডুবি হয়েছে। ২৩টি পৌরসভায় মেয়র পদে আওয়ামী লীগ ভোট পেয়েছে ৬৪ শতাংশ। বিপরীতে বিএনপি পেয়েছে সাড়ে ১৩ শতাংশ ভোট। ২৩টি পৌরসভার মধ্যে ১২টিতেই ধানের শীষের প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন। ২৩টি পৌরসভার মধ্যে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের প্রার্থী জয়ী হয়েছেন ১৮টিতে, বিএনপি জয় পেয়েছে ২টিতে, আর ৩টিতে স্বতন্ত্র প্রার্থীরা জয় পেয়েছেন।
বিশ্লেষকেরা বলছেন, সাধারণত স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ভোটের হার বেশি হয়। তবে প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে ভোটের যে হার এবং ফলাফল, তার বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বিশ্লেষকদের কারও কারও প্রশ্ন আছে।
প্রথম ধাপের সব কটি পৌরসভায় ভোট নেওয়া হয়েছে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনে (ইভিএম)। ইভিএমে কারসাজির কারচুপির অভিযোগ এনে ফলাফল প্রত্যাখ্যান করেছে বিএনপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ বলেছে, ইভিএমে ভোট গ্রহণে জনগণের আস্থা বেড়েছে। ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের এগিয়ে যাওয়ার বার্তা বহন করে।
২০১৪ সালের একতরফা জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকেই মূলত ভোটের প্রতি মানুষের অনীহা দেখা যায়। তবে ওই নির্বাচনের পর স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটের হার ভালো ছিল। ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর থেকে বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনে ভোটার খরা দেখা দেয়। গত দুই বছরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটারদের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায়নি। মাত্র ৫ শতাংশ ভোট পড়ার রেকর্ডও হয়েছে এই সময়ে।
দীর্ঘদিন পর গত সোমবার অনুষ্ঠিত প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনে বিভিন্ন কেন্দ্রে ভোটারদের দীর্ঘ সারি দেখা গেছে। ভোটের দিন বড় ধরনের কোনো সহিংসতার ঘটনাও ঘটেনি। পরিবেশ ছিল অনেকটাই উৎসবমুখর। অবশ্য বিভিন্ন জায়গায় ভোটারদের অনেকে অভিযোগ করেছেন, তাঁরা মেয়র পদে পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেননি। ভোটার আঙুলের ছাপ দিয়ে ইভিএমের ব্যালট ইউনিট চালু করার পর একটি দলের মেয়র প্রার্থীর অনুসারীরা তাঁদের পছন্দের মেয়র প্রার্থীর প্রতীকে ভোট দিয়ে দিয়েছেন।
প্রথম ধাপের পৌরসভা নির্বাচনের মূল্যায়ন করতে গিয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটের হার বেশি হয়, এটা অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে। তবে ইসি ভোটের যে হার বলছে, সেটা এবং ঘোষিত ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
ভোটের হার যাচাই করার কোনো সুযোগ নেই। ইসি যা বলছে, সেটা বিশ্বাস করতে হবে। কিন্তু বর্তমান কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা শূন্যের কোঠায়। ইভিএমে ভোটার–ভ্যারিফায়েড পেপার অডিট ট্রেইল (ভিভিপিএটি) রাখা হয়নি। ইভিএমের নিয়ন্ত্রণ ইসি ও নির্বাচন কর্মকর্তাদের হাতে। তাঁদের বিশ্বাসযোগ্যতা নেই। ইসির বিরুদ্ধে যেসব গুরুতর অভিযোগ আছে, তাতে তাদের নির্বাচন পরিচালনার নৈতিক এখতিয়ার নেই।
বিভিন্ন নির্বাচনে ভোটের হার
প্রথম ধাপে ভোটের হার ৬৫ শতাংশ হলেও তা গত পৌর নির্বাচনের চেয়ে কম। ২০১৬ সালে ২০৭টি পৌরসভা নির্বাচনে মেয়র পদে গড়ে ৭৩ দশমিক ৯২ শতাংশ ভোট পড়েছিল। এই পদে ৮০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল ৭৪টি পৌরসভায়।
গত জাতীয় নির্বাচনের পর থেকে ভোটের প্রতি মানুষের প্রকট অনীহা দেখা যায়।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দুই মাসের মাথায় ২৮ ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট পড়ে ৩০ শতাংশ। গত বছর অনুষ্ঠিত উপজেলা পরিষদ নির্বাচনের প্রথম ধাপে ভোট পড়ার হার ছিল ৪৩ দশমিক ৩২ শতাংশ। দ্বিতীয় ধাপে ৪১ দশমিক ২৫ শতাংশ। পাঁচ ধাপে ওই নির্বাচনে ভোটের হার ছিল ৪০ শতাংশের মতো।
স্থানীয় সরকারের নির্বাচনে ভোটের হার বেশি হয়, এটা অতীত অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে। তবে ইসি ভোটের যে হার বলছে, সেটা এবং ঘোষিত ফলাফলের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন আছে।
চলতি বছর অনুষ্ঠিত নির্বাচনগুলোর মধ্যে সবচেয়ে কম মাত্র ৫ দশমিক ২৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল ঢাকা-১০ আসনের উপনির্বাচনে। গত মার্চে ওই ভোট হয়েছিল। আর গত অক্টোবরে অনুষ্ঠিত ঢাকা-৫ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ১০ দশমিক ৪৩ শতাংশ। ঢাকা-১৮ আসনের উপনির্বাচনে ভোট পড়েছিল ১৪ দশমিক ১৮ শতাংশ।
চলতি বছর মোট ১১টি সংসদীয় আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এর মধ্যে ছয়টিতে ভোটের হার ৫০ শতাংশের কম ছিল। সর্বোচ্চ ৬৫ দশমিক ৭৮ শতাংশ ভোট পড়েছিল পাবনা-৪ আসনের উপনির্বাচনে।
উপনির্বাচনগুলোতে সাধারণত ভোটের প্রতি মানুষের আগ্রহ কম থাকে। কিন্তু এ বছরের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত ঢাকা উত্তর সিটিতে ভোট পড়েছিল ২৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ভোট পড়েছিল ২৯ দশমিক ০৭ শতাংশ।
অবশ্য এই বছর অনুষ্ঠিত অন্যান্য স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোতে ভোটের হার তুলনামূলক বেশি ছিল। এ বছর অনুষ্ঠিত ৭টি পৌরসভায় ৫টিতে ৬০ শতাংশের বেশি ভোট পড়েছিল। আর সবচেয়ে কম ৩৪ শতাংশ ভোট পড়েছিল চাঁদপুর পৌরসভায়। এ বছর তিনটি উপজেলা পরিষদে ভোট অনুষ্ঠিত হয়েছে। এর মধ্যে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে সর্বোচ্চ প্রায় ৬০ শতাংশ ভোট পড়েছিল। আর ফরিদপুরের চরভদ্রাসনে (পরে বাতিল করা হয়) ৪৪ শতাংশ এবং হাইমচরে চেয়ারম্যান পদে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিল।
নির্বাচন কমিশন
প্রথম ধাপের পৌর নির্বাচন প্রসঙ্গে গতকাল নিয়মিত ব্রিফিংয়ে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, পৌরসভা নির্বাচনে ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ গণতন্ত্রের এগিয়ে যাওয়ার বার্তা বহন করে। বিএনপি ইভিএমের বিরোধিতা করলেও তাদের প্রার্থীরা এই পদ্ধতিতে বিজয়ী হওয়ার মধ্য দিয়ে প্রমাণিত হয়েছে, প্রযুক্তিনির্ভর পদ্ধতিতে অনিয়মের সুযোগ নেই। আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থীরা ব্যাপক জয় পেয়েছেন, যা শেখ হাসিনা সরকারের প্রতি জনগণের আস্থার বহিঃপ্রকাশ।
মাঝপথে ভোট প্রত্যাখ্যানের নেতিবাচক রাজনীতির বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠে থাকার জন্য বিএনপিকে ধন্যবাদ জানান তিনি।
জামানত হারালেন বিএনপির ১২ প্রার্থী
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হলে মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় একটি নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা জামানত হিসাবে জমা দিতে হয়। পৌরসভায় ভোটার সংখ্যা অনুপাতে সর্বনিম্ন ১৫ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকা জামানত হিসেবে মেয়র পদপ্রার্থীদের জমা দিতে হয়। মোট প্রদত্ত ভোটের ৮ ভাগের ১ ভাগ ভোট যদি কোনো প্রার্থী না পান, তাহলে তাঁর জামানতের টাকা বাজেয়াপ্ত করা হয়। ১২টি পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জামানত রক্ষা করার মতো পর্যাপ্ত ভোট পাননি।
যেসব পৌরসভায় বিএনপির প্রার্থীরা জামানত হারিয়েছেন, সেগুলো হলো পাবনার চাটমোহর, রংপুরের বদরগঞ্জ, বরগুনার বেতাগী, মৌলভীবাজারের বড়লেখা, ঢাকার ধামরাই, ময়মনসিংহের গফরগাঁও, বরিশালের বাকেরগঞ্জ ও উজিরপুর, রাজশাহীর কাটাখালী, পটুয়াখালীর কুয়াকাটা, মানিকগঞ্জ সদর এবং সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুর।
এর মধ্যে গফরগাঁওয়ে প্রদত্ত ভোটের ৯৮ শতাংশই পেয়েছে আওয়ামী লীগ। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ধানের শীষ প্রতীকের অন্তত ১৬১ জন প্রার্থী জামানত হারিয়েছিলেন।
বিজ্ঞাপন
গতকাল ঠাকুরগাঁওয়ে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদের বলেন, এই ফলাফল কিছু কিছু পূর্বনির্ধারিত, কিছু ইভিএমের কারসাজি।
ইভিএমে যে প্রোগ্রাম ঠিক করা থাকে, সেটা সেভাবেই কাজ করে। ১০টা ভোটের ৮টা চলে যাবে নৌকায় আর ২টা যাবে ধানের শীষে, ইভিএমে এমন প্রোগ্রাম ঠিক করে দেওয়া হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন।
মির্জা ফখরুল বলেন, নির্বাচনই হয়নি, এটার আবার মূল্যায়ন কিসের। নির্বাচন কমিশনটাই ভুয়া।
২৩টি পৌরসভার মধ্যে ৮টিতে প্রদত্ত ভোটের ৮৫ শতাংশের বেশি ভোট পেয়েছেন আওয়ামী লীগের প্রার্থীরা। এগুলো হলো চাটমোহর, বেতাগী, ধামরাই, গফরগাঁও, খোকসা, কাটাখালী, মানিকগঞ্জ ও শাহজাদপুর। এর মধ্যে গফরগাঁওয়ে নৌকায় ভোট পড়েছে ৯৮ শতাংশের বেশি।
নির্বাচনে এই ভোটের হার ও ফলাফল নিয়ে কিছুটা বিস্মিত সাবেক নির্বাচন কমিশনার এম সাখাওয়াত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভোট নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে মানুষের আগ্রহ নেই। এত দিন দেখা গেছে, কাগজের ব্যালটে ভোট পড়েছে ৭০–৮০ শতাংশ। এবার ইভিএমে ৬৫ শতাংশ ভোট পড়ে থাকলে ভালো। তবে তিনি কিছুটা বিস্মিত। সাবেক এই কমিশনার বলেন, হয়তো মানুষের আস্থা ফিরে আসছে। কিন্তু একটি নির্বাচনে ভোটের হার দেখে বলা যাবে না আস্থা ফিরেছে। তিনি বলেন, যদি ভোটকেন্দ্রের বুথ দখল হয়ে যায়, তাহলে ইভিএমেও কারচুপি হতে পারে।