হলিউডের সিনেমার দৃশ্য ব্যবহার করে ভাসানচর নিয়ে অপপ্রচারের রেশ কাটতে না কাটতেই একই বিষয়ে আবারো মিথ্যাচারের নজির স্থাপন করলো ভারতীয় মিডিয়া। সম্প্রতি দ্বিতীয় দফায় ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের নতুন দল পাঠানোর পর তা নিয়ে নিয়ে ভিত্তিহীন ও বানোয়াট তথ্য প্রকাশ করেছে ভারতীয় গণমাধ্যম ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’। মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থার আপত্তি সত্ত্বেও ভাসানচরে পাঠানো হয়েছে রোহিঙ্গাদের। ভাসানচরকে ‘বিচ্ছিন্ন দ্বীপ’ আখ্যা দিয়ে টানা হয়েছে অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং জাতিসংঘের বাংলাদেশ সরকারের কাছে সিদ্ধান্ত বাতিলের আবেদনের কথাও।

প্রকাশিত প্রতিবেদনের এক জায়গায় লেখা হয়েছে-

‘এই দ্বীপটির নাম ‘ভাসান চর’। বছর ২০ আগেও এর কোনও অস্তিত্ব ছিল না। তার পর আস্তে আস্তে পলি জমে এই দ্বীপটি তৈরি হয়েছে। বর্ষার সময় নাকি এখনও ডুবে যায় এই দ্বীপটি। তবে সরকারের তরফে বন্যা আটকানোর জন্য বাঁধ দেওয়া হয়েছে। ভাসান চরে ভারতীয় মু্দ্রায় প্রায় ৮২১ কোটি ৮২ লাখ ৮০ হাজার টাকা খরচ করে ঘর বাড়ি হাসপাতাল মসজিদ তৈরি করে দিয়েছে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। ৪ ডিসেম্বর প্রথম দফায় ১ হাজার ৬৪২ জন রোহিঙ্গাকে সেখানে নিয়ে যাওয়া হয়। সে বারও মানবাধিকার সংগঠনগুলি আপত্তি তুলেছিল। তাদের দাবি, অনেক রোহিঙ্গাই সেখানে যেতে রাজি নন। তাঁদের জোর করে সেখানে পাঠানো হচ্ছে।’

বাংলাদেশের দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে ভাসানচরের মতই বহু দ্বীপ রয়েছে যেগুলোতে লাখ লাখ বাংলাদেশি জন্মসূত্রে বসবাস করে। এছাড়া অন্যান্য সমুদ্রতীরবর্তী জেলার মত ভাসানচরেও রয়েছে পর্যাপ্ত সাইক্লোন সেন্টার যা দুর্যোগ মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। অন্তত ১৭০ বছরের ঘূর্ণিঝড়ের ইতিহাস পর্যালোচনা করেই বাংলাদেশ নৌ বাহিনী ভাসান চরের রোহিঙ্গাদের জন্য স্থাপনা তৈরি করেছে। ভাসানচরের সাইক্লোন সেন্টারগুলো সম্পর্কে আরেকটি তথ্য হলো এখানকার সাইক্লোন সেন্টারগুলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে উত্তীর্ণ। ঘণ্টায় ২৯৫ কিলোমিটার গতির চেয়েও বেশি গতিসম্পন্ন ঝড়ও এই শক্তিশালী সাইক্লোন সেন্টার অনায়াসে মোকাবেলা করতে পারবে। এছাড়াও ভাসানচরের দক্ষিণে ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ রয়েছে যা বড় জলোচ্ছ্বাসের ধাক্কা সামাল দিতে পারবে।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরের যাওয়ার সম্মতির ব্যাপারে যা বলা হয়েছে তা সম্পূর্ণই ভিত্তিহীন। কেননা ভাসানচরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের পূর্বে ৪০ জনের একটি রোহিঙ্গা দলকে নিয়ে আসা হয়েছিল। তারা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে এসে পরবর্তীতে বাকি রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে আসতে উদ্বুদ্ধ করে। সময়নিউজের প্রতিবেদনের একটি ভিডিওতে দেখা যায় রোহিঙ্গারা হাসি খেলায় মেতে উঠেছেন। সেখানে শিশু-কিশোরদের সঙ্গে নানা খুনসুটিতে ব্যস্ত থাকতে দেখা যায় নৌবাহিনীর কর্মকর্তাদের। সুন্দর, আনন্দমুখর জীবন কাটানোর জন্য উখিয়ার কুতুপালংসহ বিভিন্ন আশ্রয় শিবির থেকে রোহিঙ্গারা ভাসানচরমূখী হয়েছে। এখন তাদের সেসবের বাস্তবায়ন চলছে। ইতোমধ্যে রোহিঙ্গাদের জন্য গড়ে তোরা হয়েছে দুটি পৃথক ক্লাব। একটি মিউজিক্যাল ক্লাব, অন্যটি স্পোর্টস ক্লাব।

ভাসানচরের প্রকল্পটি এমনভাবেই নির্মাণ করা হয়েছে যাতে বর্ষা বা শীতের মৌসুমে বহাল তবিয়তে টিকে থাকা যায়। তাছাড়া রোহিঙ্গাদের উন্নত জীবনমান নিশ্চিত করতে কক্সবাজার এবং ভাসানচর দুই জায়গাতেই পর্যাপ্ত পরিমাণ খাদ্য-বস্ত্র-ওষুধের মত মৌলিক চাহিদার যোগান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভাসানচরে বর্তমানেই আগামী একবছরের খাদ্য মজুদ রয়েছে। আরেকটি তথ্য হলো, ভাসানচরে চাষাবাদ ও দৈনিক আয়ের ব্যবস্থা রয়েছে।

রোহিঙ্গা বিষয়ক গবেষক প্রফেসর ড. জাকির হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘আমি মনে করি, রোহিঙ্গাদের জন্য ভাসানচর পুরোপুরি বসবাসযোগ্য হয়েছে। সেখানে বাড়ি আছে, সেখানে স্কুল আছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও সেখানে হাসপাতাল আছে। যদি কোনো কারণে ঝড় হয় সেটার জন্য শেল্টার হোম আছে। সবই আছে সেখানে।’

যে ভারতীয় গণমাধ্যম আজ ভাসানচরের বিরোধিতা করছে সেই ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধী ১৯৮৮ সালে বাংলাদেশ সফরে এসে উড়ির চরে বসতি গড়ে তুলতে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছিলেন।

উল্লেখ্য, কক্সবাজারের বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্র থেকে দ্বিতীয় দফায় তিন শতাধিক রোহিঙ্গা নিয়ে ভাসানচরের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া প্রথম জাহাজ নোয়াখালীর ভাসানচরে পৌঁছেছে। মঙ্গলবার (২৯ ডিসেম্বর) দুপুর ১টার দিকে নৌবাহিনীর জাহাজটি ভাসানচরে পৌঁছায়। পর্যায়ক্রমে বাকি চারটি জাহাজে থাকা আরও প্রায় এক হাজার ৫০০ রোহিঙ্গা ভাসানচরে এসে পৌঁছায়।

রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে স্থানান্তর নিয়ে গত দুই মাস ধরেই চলছে নানা ষড়যন্ত্র। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো যেমন এর বিরোধিতা করছে, তেমনি নেতিবাচক প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে দেশি-বিদেশি নানা সংস্থা। এর মাঝে দ্বিতীয় দফায় স্বপ্রণোদিত হয়ে ভাসানচর যেতে কক্সবাজারের আশ্রয়শিবির ত্যাগ করেছেন এক হাজার ৭৭২ জন রোহিঙ্গা। ৪২৭টি পরিবারের এসব রোহিঙ্গা সোমবার দুপুরেই বাসযোগে কক্সবাজার ছেড়ে চট্টগ্রাম আসেন। রাতে তাদের রাখা হয় বিএএফ শাহীন কলেজ মাঠে স্থাপিত অস্থায়ী ট্রানজিট ক্যাম্পে।

এর আগে গত ২০১৭ সালের আগস্টে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর গণহত্যা ও নিপীড়নের মুখে দেশটি থেকে কয়েক লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। একই বছরের নভেম্বর মাসে কক্সবাজার থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে সরিয়ে নেওয়ার লক্ষ্যে একটি প্রকল্প নেয় সরকার। আশ্রয়ণ-৩ নামে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় বাংলাদেশ নৌবাহিনীকে। সূত্র: সময়

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *