• শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪, ০৩:৫৫ পূর্বাহ্ন
শিরোনাম

করোনা কোত্থেকে এলো

Reporter Name / ১৬৫ Time View
Update : বুধবার, ২৬ মে, ২০২১

তসলিমা নাসরিন-

৩৫ লাখ লোক মরে গেল এক ভাইরাসে, ভাইরাস কোত্থেকে এলো? উহানের মাংসের দোকান থেকে? চীন সরকার জানিয়েছিল, ২০১৯ সালে ডিসেম্বরের ৮ তারিখে মাংসের দোকানে যাওয়া এক লোক অসুস্থ হয়ে পড়েছে, ওটিই প্রথম করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া প্রথম রোগী। আমেরিকার গুপ্তচর সংস্থার গোপন নথিতে আছে উহানের ভাইরাস গবেষণাগারে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসেই তিনজন গবেষক এমন অসুস্থ হয়ে পড়েন যে, তাঁদের হাসপাতালে যেতে হয় চিকিৎসার জন্য। ওঁদের অসুস্থতার উপসর্গ কিন্তু কভিড আক্রান্তদের উপসর্গের মতো ছিল। জ্বর কাশি শ্বাসকষ্ট। হতে পারে সেই তিন গবেষকের ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল, কিন্তু স্পষ্ট করে চীন থেকে জানানো হয়নি গবেষকরা ঠিক কী কারণে অসুস্থ হয়েছিলেন। ল্যাব থেকে ভাইরাস ছড়িয়েছে এই সম্ভাবনাকে চীন সব সময় জোর গলায় অস্বীকার করেছে। চীনের বিদেশ মন্ত্রক বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার লোকদের উহানের ল্যাব দেখিয়েছে এবং সাফ সাফ বলে দিয়েছে, ল্যাব থেকে ভাইরাস ছড়াবে, এ অসম্ভব। আন্তর্জাতিক ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা যে পরীক্ষা করতে চাইছেন প্রথম যে মানুষ কভিড-১৯ দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিল-তার, মাংসের বাজারের বাদুড়, প্যাংগলিন ইত্যাদি যেসব প্রাণী থেকে মানুষের মধ্যে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বলে জানানো হয়েছিল-সেসবের, চীন তাঁদের সহযোগিতা করেনি, আজও করছে না। নিজেদের গবেষণার কাগজপত্রও কিছু দেখায়নি চীন। এতেই সন্দেহটা বাড়ে। উহানের গবেষণাগার যে নিরাপদ নয়, যে কোনও সময় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে, এমন সব চিঠিও কিন্তু গবেষকরা চীন সরকারকে একসময় জানিয়েছিলেন। তাহলে কি একদিন আশঙ্কার সেই দুর্ঘটনাই ঘটে গেল, যে দুর্ঘটনার খেসারত দিতে হচ্ছে বিশ্বের লক্ষ লক্ষ নিরীহ-নিরপরাধ মানুষকে? কভিড রোগের উৎসের সন্ধানে যে বিশেষজ্ঞরা, চীন তাঁদের নিশ্চিতই উপেক্ষা করছে বলেই কিন্তু বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস আরও গভীর হচ্ছে যে কভিড-১৯-এর উৎস উহানের মাংসের বাজার নয়, উৎস উহানের ভাইরাস গবেষণাগার। চীন যদি তার গবেষণার কিছুই প্রকাশ করতে অনীহা প্রকাশ করে, তাহলে বিশেষজ্ঞরা কোনও প্রমাণ ছাড়া কেন বলবে যে চীন যা দাবি করছে তা সঠিক! করোনাভাইরাস চীনের ব্যক্তিগত বা অভ্যন্তরীণ কোনও ব্যাপার নয়, চীনের কোনও অধিকার আছে ভয়াবহ সংক্রমণের উৎস লুকিয়ে রাখার। চীন নিজের দেশকে চমৎকার করোনামুক্ত করেছে কিন্তু চীন থেকে এই ভাইরাস ছড়িয়ে গিয়ে গোটা বিশ্বকে প্রায় শ্মশান বানিয়ে ফেলেছে, তার দায় কিন্তু আজ হোক কাল হোক চীনকে নিতেই হবে।

উৎসের সন্ধানে প্রথম গবেষণা অনেকটা জোড়াতালি দিয়ে চালানো হয়েছিল। প্রমাণের চেয়ে অনুমান বেশি ছিল। চীনের গবেষকবৃন্দ এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলেছিল বাদুড়ের করোনাভাইরাস অন্য কোনও প্রাণীর শরীর হয়ে মানুষের শরীরে প্রবেশ করেছে। দ্বিতীয়বার গবেষণার চেষ্টা চলছে এখন, কারণ কিছু ঘটনা এখনও রহস্যে আবৃত, কিছু প্রশ্নের উত্তর এখনও মেলেনি। এই গবেষণায় আন্তর্জাতিক গবেষকদের হাতে করোনাভাইরাস সংক্রান্ত প্রথম দিকের সমস্ত গবেষণার নথিপত্র তুলে দিতে হবে। এবং গবেষণা কাজে তাঁদের প্রবেশের অধিকার দিতে হবে সর্বত্র। চীন যদি আবারও বাদ সাধে তবে চীনই চিহ্নিত হবে অপরাধী হিসেবে। মানুষকে অন্ধকারে ফেলে রাখা নিশ্চিতই অপরাধ।
কভিডের প্রথম ধাক্কা বেশ কিছু দেশকে কঠিন সময় দিয়েছে। প্রথম ধাক্কা কাটিয়ে উঠলেও দ্বিতীয় ধাক্কা ভারতকে শুইয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার রোগী ফুটপাতে ধুঁকেছে, একটু অক্সিজেন চাই বলে বলে দৌড়েছে, কভিডের চাপে পিঁপড়ের মতো মরেছে। এত কাঠ নেই এত লাশ পোড়ানোর। এক চিতায় পাঁচ-ছয়জনকে ওঠানো হয়েছে। কভিডের কারণে লক্ষ লক্ষ মানুষের চাকরি নেই, টাকা পয়সা নেই চিতার কাঠ কেনার, কেউ পেট্রোল দিয়ে পুড়িয়ে দিয়েছে লাশ, কেউ নদীতে ভাসিয়ে দিয়েছে মৃতদেহ। আজ নদীর জল দূষিত, নদীর মাছ বিষাক্ত। দীর্ঘদিন স্টেরয়েড অথবা অক্সিজেন নিয়ে যে ডায়াবেটিস রোগীরা কভিডে আক্রান্ত, তারা আবার নতুন করে কালো ছত্রাক, সাদা ছত্রাক, এমনকি হলুদ ছত্রাক দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছে এবং দ্রুত মরে যাচ্ছে। এত রোগ এত শোক সওয়া যায় না। চারদিকে মৃত্যুর বীভৎস উৎসব শুরু হয়েছে যেন। সবচেয়ে কষ্ট হয় ডাক্তাররা যখন মারা যান, যখন দুই ডোজ টিকা নেওয়ার পরও তাঁরা কভিডকে কাবু করতে পারেন না। শুনেছি ডাক্তার যাঁরা মারা গেছেন, সবার নাকি টিকা নেওয়া সম্পূর্ণ হয়নি। অথচ টিকা আসার সঙ্গে সঙ্গে ডাক্তারদেরই টিকা নেওয়ার কথা প্রথম। ডাক্তারদের মধ্যে টিকাবিরোধী হয়তো কেউ কেউ আছেন যাঁরা টিকা নেননি। মৃত্যুর উদবাহু নৃত্য দেখেছি, যখন নতুন ভ্যারিয়েন্ট এসে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে শহরে গ্রামে বন্দরে। আর আমরা হতবুদ্ধির মতো দাঁড়িয়ে থেকেছি, মৃত্যুকে বরণ করে নিয়েছি মৃত্যু কপালে ছিল বা এ নিতান্তই কর্মফল বা অন্য কোনও অর্থহীন সান্ত্বনা দিয়ে। টিকার অভাব চারদিকে। টিকার প্রতিক্রিয়া হচ্ছে জেনেও আমাদের টিকা নেওয়া ছাড়া গতি নেই। টিকা নিলে যত ঝুঁকি, তার চেয়ে বেশি ঝুঁকি কভিডে আক্রান্ত হলে। কভিডে মৃত্যু টিকার মৃত্যুর চেয়ে বহুগুণ বেশি। কোনও টিকা না নেওয়ার চেয়ে টিকা নেওয়া তাই কয়েক হাজার গুণ ভালো।

কিন্তু টিকাবিরোধী লোকের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ফ্রান্সের নোবেল পুরস্কার বিজয়ী ভাইরাস বিশেষজ্ঞ লুক মন্তানিয়ের দুই দিন আগে বলেছেন, ভাইরাসের কারণে শরীরে যে এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে, সেই এন্টিবডি কভিড রোগকে আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে, আর টিকার কারণে যে এন্টিবডি তৈরি হচ্ছে, সেই এন্টিবডি তৈরি করছে নতুন ভ্যারিয়েন্ট। যদি মন্তানিয়েরের মন্তব্যের কোনও মূল্য থাকতো, তাহলে অন্য ভাইরাস বিশেষজ্ঞরা তাঁকে অবজ্ঞা করতেন না। কিন্তু মহামারীতে টিকাই যখন সবচেয়ে বড় সহায়, তখন টিকার বিপক্ষে কোনও প্রমাণ ছাড়াই এমন মন্তব্য টিকা না নেওয়ায় মানুষকে উৎসাহিত করবে। জনসংখ্যার অধিকাংশ টিকা নিলে ভাইরাসকে প্রতিরোধ করা সম্ভব হবে। তা না হলে সহজ নয় এই ভাইরাসকে পৃথিবী থেকে বিদেয় করা।

লম্বা লকডাউনের কারণে দিল্লিতে কভিডের কামড় কমেছে। তাহলে এ নিশ্চিত যে লকডাউনে কিছু হলেও লাভ হচ্ছে। গত বছরের লকডাউন দেখে ঘাবড়ে গিয়ে লক্ষ লক্ষ শ্রমিক শহর ছেড়ে বাস-ট্রাক-ট্রেন-অটো-রিকশা-সাইকেলে চেপে এবং পায়ে হেঁটে হাজার কিলোমিটার দূরে তাদের গ্রামের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিল, সেই যাত্রায় দু’শ জনের মৃত্যু হয়েছিল ট্রাক-ট্রেনের ধাক্কায়, অনাহারে ক্লান্তিতে। পরিস্থিতি সামান্য ভালো হতেই সেই শ্রমিকেরা ফিরে এসেছিল আবার শহরে নগরে। দ্বিতীয় ধাক্কার কভিড-হামলা রুখতেও শহরে নগরে লকডাউন চলছে, তবে এই লকডাউনে শ্রমিকেরা আর দল বেঁধে হাইওয়েতে হাঁটতে শুরু করেনি। তারা অপেক্ষা করছে পরিস্থিতি আবার স্বাভাবিক হবে এই আশায়। আমরা সবাই অপেক্ষা করছি একদিন আবার মুখের ঢাকনা খুলে হাসতে পারবো প্রাণ খুলে। আবার আগের মতো ফিরে পাবো জীবন। এখন তো জীবন থেকেও যেন জীবন নেই। জীবন তো শুধু আর শ্বাস নেওয়া আর শ্বাস ফেলা নয়। জীবন আরও বড় কিছু। সেটিই অনেক দিন থেমে আছে।

বাংলাদেশে কালো ছত্রাক পাওয়া গেছে। ভারতে যে রোগ পাওয়া যায়, তা ক’দিন বাদেই বাংলাদেশে গিয়ে পৌঁছোয়। রোগ শোক সীমানা মানে না। মানলে চীনের ভাইরাস চীনেই থাকতো। মানুষ এক অঞ্চল থেকে আরেক অঞ্চলে বয়ে নিয়ে যায় ভাইরাস ব্যাকটেরিয়া ফাঙ্গাস। তবে একটিই আশার কথা, ভারতে কভিড যতটা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে, বাংলাদেশে ততটা করেনি। তবে বাংলাদেশে টিকাবিরোধীদের সংখ্যা নেহাত কম নয়। ভালো টিকা যে দেশ থেকেই আসুক, সবাইকে টিকা নিতে হবে, টিকার পক্ষে আন্দোলন চলতে হবে। চীনের মাংসের বাজার থেকে আসুক, বাদুড় থেকে প্যাংগলিন হয়ে বা অন্য যে কোনও প্রাণীর শরীর হয়ে আসুক, অথবা গবেষণাগার থেকে গবেষকদের ভুলে বা অসাবধানতায় বেরিয়ে গিয়ে আসুক, ভাইরাস এসে গেছে মানুষের শরীরে। ভুল সংশোধনের কোনও উপায় আর নেই। অনেকটা বোতল থেকে দৈত্য বেরিয়ে যাওয়ার মতো, একে আর বোতলফেরত পাঠানোর উপায় নেই। বেরিয়ে যখন গেছে, যাঁদের কাজ কী করে বেরোলো তার সন্ধান করা, তাঁরা করুন। আমাদের কাজ যে করেই হোক কভিডকে সমাজ সংসার থেকে বিদেয় করা, কভিডের বিধিনিষেধ পালনের পাশাপাশি টিকা নেওয়া। টিকার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াকে তুচ্ছ করে টিকা নেওয়া। অনেক রোগের ওষুধও আমরা খাচ্ছি প্রতিদিন, যে ওষুধগুলোর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেহাত কম নয়।

গত ১০০ বছরে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতির সুফলও কিন্তু আমরা পাচ্ছি। শুধু হতাশার দীর্ঘশ্বাস নয়। কিছু আশার আলোও কিন্তু আছে। ১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লুতে ৫০ কোটি থেকে ১০০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল। মৃত্যু হয়েছিল ৫ কোটি থেকে ১০ কোটি মানুষের। মোট জনসংখ্যা ছিল তখন ১৮০ কোটি। কভিড-১৯ আক্রান্ত করেছে ১৬ কোটি ৮০ লক্ষ মানুষকে, এ পর্যন্ত মৃত্যু হয়েছে ৩৫ লক্ষ মানুষের। মোট জনসংখ্যা এখন ৭৮০ কোটি। আশা করছি পৃথিবী দ্রুত সেরে উঠবে।

লেখক : নির্বাসিত লেখিকা


আপনার মতামত লিখুন :

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

More News Of This Category


[cvct title=”COVID-19 Global Stats” label-total=”Total Cases” label-deaths=”Death Cases” label-recovered=”Recovered Cases” bg-color=”” font-color=””]

[cvct title=”Coronavirus Stats” country-code=”BD” label-total=”Total Cases” label-deaths=”Death Cases” label-recovered=”Recovered Cases” bg-color=”” font-color=””]



Fact News

Fact News theme is a complete magazine theme, excellent for news, magazines, publishing and review sites. Amazing, fast-loading modern magazines theme for personal or editorial use. You’ve literally never seen or used a magazine that looks or works like this before.

https://slotbet.online/