এম শরীফ ভূঞা, ফেনী :
মধ্যপ্রাচ্যের সবজি স্কোয়াশ চাষ হচ্ছে ফেনীতে। শীতকালীন এই সবজি অতি পুষ্টিকর, সু-স্বাদু, সল্পমেয়াদি, উচ্চ ফলনশীল, লাভ জনক স্কোয়াশ চাষ করে এলাকায় বেশ স্বনাম অর্জন করেছেন নুরুল আফছার। বর্তমান তার ক্ষেতে বিষমুক্ত স্কোয়াশের ভালো ফলন হয়েছে। সেই সঙ্গে বাজারে স্কোয়াশের ফল দাম ভালো থাকায় তিনি স্কোয়াশ বিক্রি করে অনেক আয়ও করছেন।
দেখতে শসার মত কুমড়া জাতীয় সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্কোয়াশ ফেনীতে উৎপাদিত হচ্ছে। কৃষিবিদরা বলছেন, লাভজনক এ শস্যটি ফেনীর কৃষিতে যোগ করছে নতুন সম্ভাবনার। অপ্রচলিত এ সবজি চাষের উদ্যোক্তা নুরুল আফছার একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক। নিজ বাড়ি সোনাগাজী পৌরসভার দুই নম্বর ওয়ার্ডের চরচান্দিয়ায় গড়ে তোলা উদ্যোগের নাম দিয়েছেন রহমান এগ্রো। আপন ভাই শহিদল্লাহ কাওছারসহ গড়ে তোলা উদ্যোগটি বড় আকারে নিয়ে যেতে তৈরি করছেন নতুন পরিকল্পনা।
ডেফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক আফছার জানান, মাত্র ৪০ থেকে ৪৫ দিনে স্কোয়াশের ফলন পাওয়া যায়। উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় আয়ের পরিমান ছয় গুণ বেশী।
আমাদের দেশে প্রায় সব অঞ্চলেই বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির চাষ করা হয়। শাকসবজির মধ্যে স্কোয়াশ হচ্ছে অন্যতম। মিষ্টি কুমড়া জন্মায় সেসব জায়গায় এই সামার স্কোয়াশ চাষ করা যায়। স্কোয়াশ চাষ প্রতি বছর ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
স্কোয়াশে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ‘এ’ আছে। অধিকাংশ মানুষ পুষ্টির চাহিদা পূরণের জন্য শাকসবজির ওপর নির্ভর করে। সামার স্কোয়াশ অনেকটা মিষ্টি কুমড়ার মতো; সুস্বাদু ও পুষ্টিকর সবজি। এর পাতাও সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। স্কোয়াশ চাষ করে পারিবারিক পুষ্টির চাহিদা পূরণের পাশাপাশি বাড়তি আয় করাও সম্ভব।
নুরুল আফছার জানান, করোনাকালের শুরুতে বাড়িতে ছিলেন। সে সময় ছাদবাগানে ঝুঁকে পড়েন। কৃষি নিয়ে উৎসাহ থেকে অনলাইনে কৃষিভিত্তিক ইউটিউব চ্যানেল এবং গ্রুপ, পেইজ হতে কৃষি জ্ঞান নেয়ার চেষ্টা করেন। বাড়ির পাশে ৪৫ শতক জায়গায় প্রাথমিকভাবে স্কোয়াশ, ক্যাপসিকাম ও ব্রকলি করার পরিকল্পনা থাকলেও কৃষিবিদদের পরামর্শক্রমে স্কোয়াশ ও ক্যাপসিকাম চাষে মনস্থির করেন। ২০ শতক জায়গায় ১২শ গাছের লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে শুরু করেন স্কোয়াশ চাষ।
তিনি জানান, নভেম্বরের প্রথম সাপ্তাহে চারা অথবা বীজ বপনের সঠিক সময় হলেও এক মাস পিছিয়ে যান। বগুড়া হতে ৭শ চারা সবমিলে সাড়ে ৫ টাকা করে কেনেন। ৫শ বীজ কেনেন ঢাকা থেকে। ৪০ দিনের মাথায় একশ কেজির বেশী ফলন মাঠ হতে সংগ্রহ করেন। ফেনীর পাইকারি বাজারে বিক্রি করেছেন কেজি প্রতি ২০ টাকায়।
সোনাগাজী উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা প্রতাপ চন্দ্র নাথ জানান, রবি শস্যটি অপ্রচলিত হলেও খুবই লাভজনক। প্রতি গাছ থেকে গড়ে ১০টি ফলন হতে পারে। মানুষ এ সম্পর্কে জানতে পারলে উৎপাদন ও চাহিদা বাড়বে।
ছাদবাগান প্রেমী নুরুল আফসার জানান, বাড়ির ছাদে রয়েছে টমেটো, গাজর, আম, লিচুসহ নানাজাতের ফল ও সবজি। এমন অপ্রচলিত সবজি চাষ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, এমন কিছু চাইছিলাম যা মানে গুণে এবং আর্থিকভাবে অনেক বেশি লাভবান করবে। তিনি জানান, স্কোয়াশ এমন একটি উদ্ভিদ যা সারা বছরই পাওয়া যায়। এটি উদ্ভিদগতভাবে একটি ফল হিসেবে বিবেচিত হলেও, মসৃণ ত্বক, ছোট বীজ এবং মাংসল শাঁস এর জন্য এটিকে সবজি হিসেবে গণ্য করা হয়। ফেনী, নোয়াখালী অঞ্চলে অনেকের কাছে এটি কুছা হিসেবেও পরিচিত। এটি দক্ষিণ আমেরিকার জনপ্রিয় একটি খাদ্য। ফেনীর স্থানীয় বাজারে এ মুহূর্তে সবজির দর নিম্নমুখী হলেও উৎপাদন ব্যয়ের তুলনায় স্কোয়াশে আয়ের পরিমাণ ছয় গুণ বেশী।
সানরাইজ যুব ওয়েলফেয়ার ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ডিপ্লোমা কৃষিবিদ আবদুল্লাহ আল মারুফ জানান, দেশের বিভিন্ন স্থানে সামার স্কোয়াশ চাষ করা হচ্ছে। যারা বেকারত্ব ঘোচাতে চান তারা বিদেশী সবজি স্কোয়াশ চাষ করতে পারেন। এটি খুবই লাভজনক। সামার স্কোয়াশ চাষ কীভাবে করা যায়, চাষ করার জন্য প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে কিনা, এক বিঘা জমির উৎপাদন খরচ, এর পুষ্টিমান এবং সর্বোপরি এর মাধ্যমে কীভাবে বেশি আয় করা সম্ভব, সে বিষয়ে আগে জানতে হবে। এ জন্য উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর কাজ করে যাচ্ছে।
সেনাগাজী উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা সাজ্জাদ হোসেন জানান, “সুস্বাদু ও পুষ্টিকর স্কোয়াশ ফেনীর কৃষিতে নতুন যোগ হল। এর দামও ভাল, বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদে কৃষক আর্থিকভাবে অধিক লাভবান হবে”।
স্কোয়াশের পুষ্টি সম্পর্কে ২৫০ শয্যা ফেনী জেনারেল হাসপাতালের আরএমও ডাঃ ইকবাল হোসেন বলেন, প্রতিটি স্কোয়াশ ফলে রয়েছে ভিটামিন এ, সি, ই ও ভিটামিন বি-৬। স্কোয়াশ সবজিতে নায়াসিন, থায়ামিন, প্যানথোটোমিন এসিড ও ফলিড রয়েছে। এছাড়াও অনেক মিনারেলস রয়েছে। যেমন রয়েছে- ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, পটাসিয়াম, খনিজ, কপার, ম্যাঙ্গানিজ, ফসফরাস, আয়রন, ক্যারোটিনয়েড এবং অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান। স্কোয়াশ ফল প্রতিদিন খেলে ডায়েট কন্ট্রোল করে। তাছাড়া নিয়মিত স্কোয়াশ খেলে ফ্রি রেডিকেলসের হাত থেকে শরীরকে রক্ষা করে।
ফেনী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক বলেন, স্কোয়াশ মূলত একটি শীতকালীন ও বিদেশি জাতের সবজি। এটি মিষ্টি কুমড়ার মতো সুস্বাদু ও পুষ্টিকর। মধ্যপ্রাচ্যের এই স্কোয়াশ চাষ অল্প খরচের ফসল। দ্রুত বর্ধনশীল একটি সবজি ও অল্প পরিশ্রমেই অধিক আয় করা সম্ভব। এ ফসলে কোনো রোগের উপদ্রব তেমন নেই। দেশের প্রচলিত কোনো সবজির এমন ভালো উৎপাদন ক্ষমতা নেই। স্কোয়াশ চাষ সম্প্রসারণ করা গেলে কৃষি অর্থনীতিতে বড় পরিবর্তন আসবে।
2021-02-25