ভবিষ্যতে বিশ্ব অর্থনীতির মূল নিয়ামক হবে সমুদ্র অর্থনীতি। এর কারণ শুধু স্থলভাগের প্রাকৃতিক সম্পদ হ্রাস পাওয়াই নয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গুণে সমুদ্রের বিশাল খনিজ ও প্রাণিজসম্পদের ভাণ্ডার থেকে তা আহরণের অধিকতর সম্ভাবনার উত্তরোত্তর বৃদ্ধিও। এ ছাড়া বিশ্বে বিভিন্ন ধরনের পরিবহনের বৈপ্লবিক উন্নতি সাধিত হলেও এখন পর্যন্ত আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৭৫ শতাংশ পণ্য বাহিত হয় সমুদ্রপথে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে সম্পদভাণ্ডার হিসেবে সমুদ্রের গুরুত্ব বৃদ্ধি ও ঔপনিবেশিক বিশ্বে অনেক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে অবস্থার আমূল পরিবর্তন ঘটে।
উন্নয়নশীল এই রাষ্ট্রগুলোর আন্দোলনের ফলে সমুদ্রের ব্যবস্থাপনা ও সমুদ্র আইনের গুণগত পরিবর্তনের জন্য জাতিসংঘ সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করে, যার ফলাফলই হচ্ছে ১৯৭৩ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত ইতিহাসের দীর্ঘতম সময় ধরে চলা সমুদ্র আইন বিষয়ে জাতিসংঘ সম্মেলন। স্বাক্ষরিত হয় সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তি ১৯৮২। এর ফলে সমুদ্রের ব্যবস্থাপনা, নৌপরিবহন, সম্পদ ও উপকূলীয় রাষ্ট্রের এখতিয়ারের ক্ষেত্রে বিপ্লবাত্মক পরিবর্তন আসে।
এই চুক্তির মূল দিকগুলো হচ্ছে- (ক) রাষ্ট্রীয় সমুদ্রের সীমা তিন নটিক্যাল মাইল থেকে বারো নটিক্যাল মাইলে সম্প্রসারিতকরণ; (খ) উপকূলের ভিত্তি রেখা থেকে সমুদ্রে ২০০ নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত উপকূলীয় রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা, যেখানে সমুদ্র তলদেশ ও জলরাশিতে বিদ্যমান সব প্রাণিজ ও খনিজসম্পদ এবং সম্ভাব্য অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর উপকূলীয় রাষ্ট্রের একচ্ছত্র অধিকার; (গ) এই ২০০ নটিক্যাল মাইল পরে বিশাল সমুদ্র তলদেশ ও তার সম্পদ সমগ্র মানবজাতির অভিন্ন সম্পদ (Common Heritage of Mankind) বলে গণ্য করা; (ঘ) এই অফুরন্ত সম্পদের ব্যবস্থাপনা, রক্ষণাবেক্ষণ, সম্পদ আহরণ ও পরিবেশ রক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সমুদ্র তলদেশ কর্তৃপক্ষ (International Sea Bed Authority) প্রতিষ্ঠা যার অনুমতি ছাড়া কোনো রাষ্ট্র বা সংস্থা এখানে কোনো সম্পদ আহরণ করতে পারবে না; (ঙ) সক্ষম রাষ্ট্র ও সংস্থা শুধু অনুমতি গ্রহণই নয়, তার লভ্যাংশের নির্ধারিত অংশ তলদেশ কর্তৃপক্ষকে প্রদান করবে, যা থেকে উন্নয়নশীল রাষ্ট্র বিশেষ সুবিধা পাওয়ার অধিকারী হবে।
আন্তর্জাতিক সমুদ্র তলদেশ কর্তৃপক্ষের কার্যক্রম এখনো যথেষ্ট গতিশীলতা অর্জন না করলেও উপকূলীয় রাষ্ট্রের এখতিয়ারের যে ব্যাপক সম্প্রসারণ ও অধিকার বৃদ্ধি ঘটছে তা বাস্তবে প্রতিষ্ঠা এবং শক্তিশালী করার প্রক্রিয়া উল্লেখযোগ্য গতিশীলতা ও ব্যাপকতা লাভ করেছে। এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে প্রতিবেশী অর্থাৎ মুখোমুখি বা পাশাপাশি অবস্থিত উপকূলীয় রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে নিজ নিজ সমুদ্রসীমা চিহ্নিত বা নির্ধারণ করা।
প্রতিবেশীর সঙ্গে সমুদ্রসীমা বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে বাংলাদেশ-ভারত-মিয়ানমার হচ্ছে সবচেয়ে জটিল উদাহরণ। সমুদ্র চুক্তির অধীন বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা তথা ট্রাইব্যুনাল বা সালিসির বিধান থাকলেও কোনো বিরোধী রাষ্ট্রকে তার সম্মতি ছাড়া আদালত বা সালিসি আদালতে নেওয়া কঠিন।
প্রতিবেশী মিয়ানমার ও ভারতকে সমুদ্র চুক্তির অধীন ট্রাইব্যুনাল ও সালিসিতে রাজি করানো ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। মিয়ানমারের সঙ্গে বিরোধ নিষ্পত্তিতে সমুদ্র আইনবিষয়ক ট্রাইব্যুনালের রায়ও ছিল বাংলাদেশের জন্য বড় সাফল্য। এ রায়ের ফলে বাংলাদেশের এক লাখ ১০ হাজার বর্গ নটিক্যাল মাইল সমুদ্র অঞ্চল নিষ্কণ্টক হয়। ভারতের সঙ্গে বিরোধের রায়ও শিগগিরই সালিসি আদালত কর্তৃক ঘোষিত হবে। আমরা আশাবাদী, এ রায়েও আমাদের একটি বড় সমুদ্র অঞ্চল নিষ্কণ্টক হবে।
এখন বাংলাদেশের করণীয় বিষয়ের মধ্যে একটি হচ্ছে পক্ষরাষ্ট্র হিসেবে আমাদের রাষ্ট্রীয় সমুদ্র ও সামুদ্রিক অঞ্চলবিষয়ক আইন Territorial Waters and Maritime Zones Act-১৯৭৪ সংশোধন করে তা ১৯৮২ সালের সমুদ্র আইনবিষয়ক আন্তর্জাতিক চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। আইন কমিশন এ বিষয়ে সরকারের কাছে প্রয়োজনীয় সুপারিশ পাঠিয়েছে। আমাদের বিশ্বাস, সরকার এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবে। এখন জরুরি ভিত্তিতে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে- (১) আমাদের সমুদ্র অঞ্চলের সম্পদের সঠিক জরিপ করা; (২) সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণ নিশ্চিতকরণ; (৩) দেশি ও বিদেশি বিনিয়োগের মাধ্যমে সম্পদের আহরণ; (৪) সমুদ্র অঞ্চলের সুরক্ষা; (৬) সমুদ্র বিজ্ঞান ও সম্পদের গবেষণা এবং অধ্যয়ন ত্বরান্বিত করা।
গ্রিনহাউস গ্যাস উদগিরণ ও অন্যান্য কারণে বিশ্ব উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে সমুদ্রের লবণাক্ততা ও সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ছাড়াও অনেক কারণে সমুদ্রের দূষণ বৃদ্ধি পেয়ে জীবন, সম্পদ ও প্রকৃতির ভারসাম্যের প্রতি হুমকি সৃষ্টি করছে। দূষণের উৎস চিহ্নিত করে এগুলো মোকাবিলা করা জরুরি।
আমাদের সমুদ্রসীমা ও সম্পদ রক্ষার প্রধান দায়িত্ব নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডের সদস্যদের। পরিবেশ রক্ষায়ও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেন। এ ক্ষেত্রে এই দুই বাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধি জরুরি। সমুদ্রবিজ্ঞান, সমুদ্রসম্পদ ও পরিবেশ বিষয়ে অধিকতর গবেষণা ও অধ্যয়ন প্রয়োজন। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে আলাদা বিভাগ বা ইনস্টিটিউট থাকলেও তা অপ্রতুল। সব বিশ্ববিদ্যালয়েই এর ব্যবস্থা ছাড়াও বিশেষায়িত ইনস্টিটিউট অপরিহার্য। কক্সবাজারে এ ধরনের একটি বিশেষ ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার কাজ বহুদিন থেকে চলছে, কিন্তু অত্যন্ত ধীর গতিতে। এটির দিকে সরকারের বিশেষ নজর দেওয়া উচিত। আমরা আশা করি, ইনস্টিটিউটটি প্রতিষ্ঠা ও এর সঠিক কার্যক্রম সমুদ্রবিজ্ঞান, সম্পদ ও পরিবেশ গবেষণায় গতি সঞ্চার করবে।
সমুদ্র অঞ্চল ও এর পরিবেশ রক্ষা এবং সম্পদের টেকসই আহরণের জন্য একটি বহুমুখী পরিকল্পনা প্রয়োজন। সরকারের একাধিক মন্ত্রণালয় ও সংস্থাকে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। এসব কার্যক্রম সমন্বয় ও মনিটর করার জন্য জাতীয় পর্যায়ে একটি উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পরিষদ বা কমিশন গঠন করা বাঞ্ছনীয়।